মা-ছেলের সম্পর্কের গল্প: নিবিড় বন্ধন

শহর থেকে দূরে, ছায়া সুনিবিড় একটি গ্রামে বাস করত অপু (৭) এবং তার মা সর্বাণী (৩০)। অপুর বাবা তাদের জন্মের পরপরই এক দুর্ঘটনায় মারা যান। সর্বাণী সমাজের সমস্ত প্রতিকূলতা আর দারিদ্র্যকে উপেক্ষা করে একমাত্র ছেলেকে বুকে আগলে বড় করতে লাগলেন। সর্বাণীর কাছে অপু শুধু ছেলে নয়, সে ছিল তার জীবনের আলো, তার অস্তিত্বের শেষ সম্বল।

সর্বাণী দিনরাত পরিশ্রম করতেন। ভোরে উঠে গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে কাজ করতেন, দুপুরে পুকুর থেকে মাছ ধরে বিক্রি করতেন, আর রাতে মোমবাতির আলোয় সেলাই করে কিছু বাড়তি রোজগার করতেন। তাঁর ছেঁড়া আঁচলের তলায় অপু সবসময় সুরক্ষিত থাকত।

অপু ছিল খুবই শান্তশিষ্ট এবং তার মায়ের প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল। সে জানত তার মা কত কষ্ট করেন। একদিন অপু স্কুল থেকে ফিরে দেখে, তার মা জ্বরে কাবু হয়ে মেঝেতে শুয়ে আছেন।

অপু মায়ের কপালে হাত রাখল। “মা, তোমার অনেক জ্বর। আমি কী করব?”

সর্বাণী দুর্বলভাবে হাসলেন। “কিছু না, বাবা। তুই শুধু একটু জল এনে দে।”

অপু দ্রুত কুয়ো থেকে জল আনল, ভিজে গামছা করে মায়ের কপালে দিল। তারপর সারা রাত মায়ের পাশে বসে রইল। সকালে উঠে সে কোনো কথা না বলে, তার টিফিনের জন্য রাখা দুটো মুড়ি নিয়ে পাশের গ্রামের এক বাড়িতে গেল, যেখানে তার মা কাজ করতেন।

“কাকিমা, আজ মা কাজে আসতে পারবেন না। মায়ের খুব জ্বর,” অপু বলল। “আপনারা কি মাকে একটু দেখতে যাবেন?”

অপুর এই সরলতা দেখে গ্রামের লোকেরা বুঝতে পারল, এই ছোট ছেলেটি তার মায়ের জন্য কতটা ভাবে।

অপুর যখন দশ বছর বয়স, তখন সর্বাণী তাকে একটি নতুন জামা কিনে দেওয়ার জন্য অনেক টাকা জমিয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই একদিন স্কুল থেকে ফিরে অপু দেখল, তাদের ঘরের চালের একটি বড় অংশ ঝড়ে উড়ে গেছে।

মা-ছেলে দুজনেই আকাশের দিকে তাকাল। বৃষ্টি আসছে।

অপু মাকে বলল, “মা, চালটা সারাতে কত টাকা লাগবে?”

“অনেক টাকা, বাবা,” সর্বাণী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “এখন আর তোর নতুন জামা হবে না।”

অপু তখন মায়ের হাত ধরল। “নতুন জামা না হলে কী হবে, মা? তুমি আর আমি তো একসঙ্গেই আছি। এটাই আসল জামা।”

অপু তার জমানো সমস্ত টাকা মাকে দিয়ে বলল, “তুমি চাল সারানোর ব্যবস্থা করো। আমি বন্ধুদের পুরোনো জামা পরে নেব।”

সর্বাণী ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়ছিল—সেটা দুঃখের নয়, গর্বের। তিনি বুঝতে পারলেন, দারিদ্র্য তাদের প্রেমকে আরও নিবিড় করেছে, আরও শক্তিশালী করেছে।

অপুর যখন কলেজে পড়ার সময় এল, তখন সর্বাণীর একমাত্র স্বপ্ন ছিল—তার ছেলে যেন শহরে গিয়ে ভালো করে লেখাপড়া করতে পারে। কিন্তু শহরের খরচ অনেক।

সর্বাণী তাই তার বাবার কাছ থেকে পাওয়া একমাত্র স্মৃতি—একটি রুপার হার—বিক্রি করে দিলেন।

অপু জানতে পেরে মায়ের হাতে ধরল। “মা, আমি শহরে যাব না। আমি এখানেই কাজ করব, আর তোমার সেবা করব।”

সর্বাণী কঠিন হলেন। “চুপ কর! আমি তোর ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে দেব না। তুই যদি পড়াশোনা না করিস, তবে আমার এত কষ্টের কোনো মূল্য থাকবে না। মনে রাখিস, আমার ভালোবাসা তোর সফলতার মধ্যেই বেঁচে থাকবে। তুই যা, আর আমাকে আর কোনো কথা বলিস না।”

মায়ের আদেশ অমান্য করতে পারল না অপু। চোখের জল নিয়ে সে শহরের দিকে রওনা হলো। শহরের হোস্টেলে বসে সে প্রতিজ্ঞা করল—সে এমন কিছু করবে, যাতে তার মাকে আর কখনও কষ্ট করতে না হয়।

অপু কঠোর পরিশ্রম করল। তার কলেজের রেজাল্ট ছিল দুর্দান্ত। একসময় সে একটি নামীদামি কোম্পানিতে ভালো বেতনে চাকরি পেল। তার প্রথম বেতন পাওয়ার দিন সে সবার আগে তার গ্রামের মায়ের কাছে ফিরে এল।

অপু এসে দেখল, সর্বাণী আজও সেই পুরোনো কুটিরেই থাকেন, আর এখনও সেলাই করেন। অপু তার মাকে জড়িয়ে ধরল।

“মা, আর নয়। তোমার কষ্ট শেষ।”

অপু তার মায়ের হাত ধরে শহরে নিয়ে এল। একটি ছোট, সুন্দর ফ্ল্যাট, যেখানে সর্বাণীর জন্য ছিল একটি বড় বারান্দা, যেখানে তিনি তার পছন্দের ফুলগাছ লাগাতে পারবেন।

কিন্তু সর্বাণী নতুন ফ্ল্যাটে এসেও নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। তার সব সময় মনে হতো, তিনি গ্রামের জীবন ছেড়ে এসে ছেলেকে শুধু খরচ বাড়াচ্ছেন।

একদিন সর্বাণী অপু-কে বললেন, “বাবা, তুই কেন এত করছিস? আমার এখানে ভালো লাগে না। আমি চাই, তুই বিয়ে কর, ঘর সংসার কর।”

অপু হাসল। “মা, তুমিই আমার ঘর, আর তুমিই আমার সংসার। তুমি এত কষ্ট করে আমাকে বড় করেছো, আর আজ তুমি যখন একটু আরাম করবে, তখন তুমি চলে যেতে চাইছো? তোমার ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারব না। তুমি এখানে না থাকলে আমার এই সাফল্য মূল্যহীন।”

অপু তার প্রথম বেতনের টাকা দিয়ে সর্বাণীর জন্য একটি হীরের আংটি কিনে এনেছিল—যা তার রুপার হারের চেয়েও অনেক বেশি দামি। অপু সেই আংটিটি মায়ের হাতে পরিয়ে দিল।

“মা, এটা রুপার হার নয়, এটা হলো তোমার ত্যাগের প্রতিদান। আমার জীবন, আমার ভালোবাসা—সবটাই তোমার।”

সর্বাণী অপুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। সেই কান্না ছিল এক মায়ের চরম তৃপ্তির, যার ভালোবাসা আজ সফল হয়েছে। মা আর ছেলের ভালোবাসার এই বন্ধন ছিল পৃথিবীর সবথেকে পবিত্র এবং নিবিড় বন্ধন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *