সময় দ্রুত পাল্টে গেল। দুই বছর পর।
অয়নের কঠোর পরিশ্রম, তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ ক্ষমতা এবং অবিশ্বাস্য সততা মি. রণজয় চৌধুরীর নজর কাড়ল। অয়ন কেবল শ্রমিকদের সমস্যা নয়, বরং ফ্যাক্টরির উৎপাদন খরচ, অপচয় এবং লজিস্টিকসের প্রতিটি খুঁটিনাটি বের করে এনে তা কার্যকরভাবে সমাধান করে দিচ্ছিল।
রণজয় চৌধুরী তার ব্যবসায় অয়নের প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হলেন। তিনি অয়নের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেন এবং ধীরে ধীরে তাকে কোম্পানির উচ্চ পদে উন্নীত করলেন। অয়ন এখন আর ফ্যাক্টরির সামান্য কর্মী নয়, সে এখন রণজয় চৌধুরীর প্রধান নির্বাহী সহকারী (Chief Executive Assistant)। তার বেতন আকাশছোঁয়া, তার হাতে এখন বিশাল ক্ষমতা। অয়নের জীবনধারা এখন সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে—সে এখন সমাজের সেই স্তরের একজন, যেখানে আগে তার প্রবেশাধিকার ছিল না।
এক সন্ধ্যায়, রণজয় চৌধুরী হাসিমুখে অয়নকে বললেন, “অয়ন, তুমি শুধু আমার ব্যবসা নয়, আমার জীবনও পাল্টে দিয়েছো। এখন আমার একমাত্র ইচ্ছা—তোমাকে আমার ব্যবসায় পূর্ণ অংশীদার হিসেবে দেখতে চাই।”
অয়ন সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু তার মনে এখনও পুরোনো ব্যর্থতার জ্বালা বিদ্যমান। তার এই উত্থান কেবল টাকার জন্য নয়, এটা তার আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধারের জন্য।
এক মাস পর, রণজয় চৌধুরীর কোম্পানি একটি বড় সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। এই অনুষ্ঠানটি ছিল শহরের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের জন্য আয়োজিত। রণজয় চৌধুরী অয়নকে তার প্রতিনিধি হিসেবে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বললেন।
অয়ন সেই পুরোনো শহরের পথে ফিরল। যেই শহর একদিন তাকে তাচ্ছিল্য করেছিল, আজ সে সেখানেই ফিরল একজন সফল ব্যক্তিত্ব হিসেবে।
অনুষ্ঠানটি ছিল এক বিলাসবহুল হোটেলে। অয়ন যখন তার দামী স্যুট এবং আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে হলঘরে প্রবেশ করল, তখন অনেকেই তার দিকে তাকাল। কেউ তাকে চিনতে পারল না, কিন্তু সবাই বুঝতে পারল, এই ব্যক্তি একজন ক্ষমতাবান মানুষ।
অয়ন হাসল। এই হাসি কেবল সফলতার নয়, এটা ছিল এক গভীর প্রতিশোধের।
কিছুক্ষণ পর, অয়নের চোখে পড়ল এক পরিচিত মুখ। তিনি আর কেউ নন—শ্রেয়ার বাবা। তিনি তার পরিচিতজনদের সাথে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন, তার মুখে সেই পুরোনো অহংকার। অয়নকে দেখে তিনি চিনতে পারলেন না, কিন্তু সম্মান জানালেন—একজন নতুন, সফল ব্যবসায়ী হিসেবে।
শ্রেয়ার বাবা এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিলেন। “আসুন, আমি আপনাকে আগে দেখিনি। আমি অমিত রায়। আপনার পরিচয়?”
অয়ন শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আমার নাম অয়ন সেন। রণজয় চৌধুরীর কোম্পানির প্রধান প্রতিনিধি।”
অমিত রায়ের মুখ সাদা হয়ে গেল। তিনি যেন তার অতীতকে মুহূর্তে সামনে দেখতে পেলেন। এই সেই ছেলে, যাকে তিনি একসময় তাচ্ছিল্য করেছিলেন, আজ সে তার চেয়েও উঁচু সামাজিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে!
ঠিক তখনই, অয়নের পেছনে মিষ্টি একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
“বাবা, তুমি কার সাথে কথা বলছো?”
অয়ন পিছনে ফিরল। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে শ্রেয়া।
শ্রেয়াকে দেখে অয়নের বুকের ভেতরটা হঠাৎ করে মোচড় দিয়ে উঠল। এত বছর পরও সে একই রকম সুন্দর। কিন্তু এখন তার চোখে সেই পুরোনো সরলতা নেই, আছে এক ধরনের ক্লান্তি।
শ্রেয়া প্রথমে অয়নকে চিনতে পারল না। তারপর তার চোখ যখন অয়নের চোখে পড়ল, সে থমকে গেল। অয়নের বদলে যাওয়া চেহারা, পোশাক এবং তার চোখে লুকিয়ে থাকা পুরোনো বেদনা—সবকিছু মিলে শ্রেয়া বুঝতে পারল, এটা তারই অয়ন!
“অ…অয়ন?” শ্রেয়ার কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল।
অমিত রায় বিচলিতভাবে বললেন, “শ্রেয়া, উনি হলেন মি. অয়ন সেন। রণজয় চৌধুরীর প্রতিনিধি।”
শ্রেয়া অয়নের দিকে তাকাল। অয়ন হাসল, কিন্তু সেই হাসিতে কোনো আবেগ ছিল না, ছিল কেবল শুষ্ক সৌজন্যবোধ।
“কেমন আছো, শ্রেয়া?” অয়ন জিজ্ঞেস করল।
“আমি ভালো,” শ্রেয়া ফিসফিস করে বলল। তার দৃষ্টিতে এখন আর তাচ্ছিল্য নেই, আছে অপরাধবোধ আর অবাক হওয়া।
অমিত রায় দ্রুত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেন। “মি. সেন, আমি খুবই দুঃখিত। আগে আপনাকে চিনতে পারিনি। আমার মেয়ে শ্রেয়া, বিদেশ থেকে ফিরেছে। আপনার সাথে এর আগে…”
“হ্যাঁ, মিস্টার রায়,” অয়ন শান্তভাবে বলল। “আপনার সাথে আমার আগে দেখা হয়েছিল। আপনার পুরোনো বাড়ির সামনে, আমার নোংরা পোশাকে।”
অমিত রায়ের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল।
অয়ন শ্রেয়ার দিকে তাকাল। “তুমি ভালো আছো জেনে খুশি হলাম, শ্রেয়া। তোমার বাবা চেয়েছিলেন, আমি যেন তোমাকে ভুলে যাই। আমি চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ব্যর্থতা, যা তোমরা আমাকে দিয়েছিলে, সেটা আমাকে ভুলতে দেয়নি। সেই ব্যর্থতাই আমাকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে।”
শ্রেয়া অয়নকে একপাশে ডেকে নিল।
“অয়ন, আমি জানি তুমি আমার ওপর রাগ করে আছো। আমার বাবার ব্যবহারের জন্য আমি ক্ষমা চাইছি। আর… আর আমার চলে যাওয়ার জন্যেও।”
অয়ন স্থির চোখে তার দিকে তাকাল। “ক্ষমা চাইতে হবে না, শ্রেয়া। তোমার চলে যাওয়া আমার জীবনের সেরা শিক্ষা ছিল। তুমি সেদিন চলে না গেলে, আমি হয়তো আজও সেই চায়ের দোকানেই থাকতাম।”
শ্রেয়ার চোখে জল এল। “তুমি কি এখনও… আমাকে ভালোবাসো?”
অয়ন গভীর নিঃশ্বাস নিল। সেই ভালোবাসার আগুন এখন হয়তো নিভে গেছে, কিন্তু তার জায়গায় এসেছে এক কঠিন বাস্তববোধ।
“ভালোবাসা? আমি জানি না, শ্রেয়া। আমি তোমাকে কোনোদিন ভুলতে পারিনি। কিন্তু এই ভালোবাসা এখন আমার জীবন নয়। আমার জীবন এখন আমার কাজ, আমার সাফল্য। আমি এখন আর সেই গরিব ছেলে নই, যার ভালোবাসা তোমার বাবার কাছে মূল্যহীন ছিল।”
অয়ন তার পকেট থেকে সেই পুরোনো চাবির রিংটা বের করে টেবিলের ওপর রাখল।
“এই রিংটা, আর তোমার বিদায়ের চিঠি—এই দুটোই ছিল আমার পুঁজি। আজ আমার কাছে টাকা আছে, সম্মান আছে। কিন্তু এখন, তোমার বাবার চোখে সেই সম্মান দেখতে পাওয়ার পর, আমার মনে হলো… আমার সেই ভালোবাসা আর এই সফলতার কোনো মিল নেই।”
অয়ন ঘুরে দাঁড়াল। “ভালো থেকো, শ্রেয়া। আমি তোমার জীবনে আর ফিরে আসব না। কারণ আমি যে কারণে তোমাকে হারিয়েছিলাম, আজ সেই কারণটা দূর হয়ে গেলেও, আমার হৃদয়ের আঘাতটা রয়ে গেছে। আর সেই আঘাত আমাকে আজ আর তোমাকে গ্রহণ করতে দেয় না।”
অয়ন হলঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তার পেছন থেকে শ্রেয়া ‘অয়ন!’ বলে চিৎকার করে উঠল। কিন্তু অয়ন আর ফিরে তাকাল না। সে তার জীবনের হিসেব চুকিয়ে দিয়ে গেল। তার পকেটে আর শূন্যতা নেই, কিন্তু তার হৃদয়ের এক কোণ এখনও শূন্য রয়ে গেল—যা কোনোদিন পূর্ণ হবে না।
