নতুন শহরে কুলির কাজ করতে করতে অয়নের কেটে গেল এক বছর। তার শরীর এখন লোহার মতো শক্ত, কিন্তু তার মন কেবলই জ্ঞান অর্জনের সুযোগ খুঁজছে। সে বুঝতে পারে, কেবল শারীরিক পরিশ্রম দিয়ে প্রাচুর্য আসে না—চাই মস্তিষ্ক খাটাতে জানতে হবে।
রাতে কাজ শেষে, যখন অন্য শ্রমিকরা ঘুমিয়ে পড়ত, অয়ন তখন তার শেষ সম্বল কয়েকটি বই নিয়ে বসত। সে বিশেষ করে অর্থনীতি, বাজার বিশ্লেষণ এবং ব্যবসা সংক্রান্ত বইগুলো পড়ত। লাইব্রেরিতে যাওয়ার সুযোগ নেই, তাই সে পুরোনো কাগজের স্তূপ থেকে ফেলে দেওয়া ম্যাগাজিন আর খবরের কাগজ কুড়িয়ে নিত।
একদিন রাতে, সে একটি ছেঁড়া ফিনান্সিয়াল ম্যাগাজিনে একটি ছোট খবর দেখল। সেখানে লেখা ছিল, এই শহরের এক বড় শিল্পপতি, মি. রণজয় চৌধুরী, তার ব্যবসার সম্প্রসারণের জন্য কিছু নতুন, বুদ্ধিমান ও পরিশ্রমী তরুণ খুঁজছেন। তাদের কাজের ক্ষেত্র হবে সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের মতো জটিল জায়গা।
রণজয় চৌধুরীর নামটা শহরে খুবই পরিচিত—তিনি আত্মনির্ভরশীল একজন সফল ব্যবসায়ী।
অয়নের মনে নতুন আশা জন্ম নিল। সে জানে তার কোনো সার্টিফিকেট নেই, কিন্তু তার আছে এক তীব্র ইচ্ছাশক্তি আর ব্যবহারিক জ্ঞান।
পরের দিন, অয়ন তার কুলির কাজ থেকে ছুটি নিল। তার একমাত্র ভালো পোশাকটি পরে (যা শ্রেয়ার দেওয়া ছিল) সে মি. রণজয় চৌধুরীর বিশাল কর্পোরেট অফিসের দিকে রওনা হলো।
অফিসের অভ্যর্থনাকারী অয়নকে দেখে প্রথমে পাত্তা দিল না। তার সাধারণ পোশাক এবং হাতের পুরোনো ব্যাগ দেখে সে ধরে নিল অয়ন হয়তো ভুল করে এসেছে।
“স্যার, আমি মি. চৌধুরীর সাথে দেখা করতে এসেছি,” অয়ন আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল।
“আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে? আর আপনি কোন কোম্পানি থেকে এসেছেন?” অভ্যর্থনাকারী তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল।
অয়ন সবিনয়ে বলল, “আমার কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই। আমি একজন প্রার্থী, যিনি তার নতুন ব্যবসার জন্য কাজ করতে আগ্রহী। প্লিজ, শুধু একবার তাকে বলুন যে আমি তার বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে এসেছি।”
অয়নের চোখে এমন এক দৃঢ়তা ছিল যে অভ্যর্থনাকারী অনিচ্ছা সত্ত্বেও একবার ফোন করল।
কিছুক্ষণ পর, অয়নকে অবাক করে দিয়ে তাকে উপরে ডেকে পাঠানো হলো। অয়ন যখন রণজয় চৌধুরীর বিশাল এবং জমকালো অফিসে প্রবেশ করল, দেখল সেখানে আরও প্রায় পঁচিশ জন সুসজ্জিত, ডিগ্রিধারী তরুণ-তরুণী ইন্টারভিউর জন্য অপেক্ষা করছে।
অয়নকে সবার শেষে ডাকা হলো। রণজয় চৌধুরী ছিলেন একজন কঠোর চেহারার মানুষ, যার চোখে ছিল গভীর বিশ্লেষণ।
“তুমি এখানে কেন এসেছো?” রণজয় চৌধুরী সরাসরি প্রশ্ন করলেন। “তোমার বায়োডাটা কোথায়? তোমার শিক্ষাগত যোগ্যতা কী?”
অয়ন শান্তভাবে উত্তর দিল, “স্যার, আমার কোনো কাগজের ডিগ্রি নেই। আমার বায়োডাটা আমার হাতে। আমি এই এক বছর আপনার শহরের এক নির্মাণাধীন সাইটে কুলি হিসেবে কাজ করেছি।”
ঘরে হাসির রোল উঠল। অন্যান্য প্রার্থীরা হাসছিল। কিন্তু অয়ন অবিচল রইল।
“তাহলে তুমি কী দিতে পারো আমাদের?” রণজয় চৌধুরী কৌতূহলী হলেন।
“আমি আপনাকে বাস্তব জ্ঞান দিতে পারি, স্যার। বাজারের সবচেয়ে নিচুতলার মানুষের শ্রমের দাম কীভাবে কমে যাচ্ছে, কীভাবে সাপ্লাই চেইনের ভুলের কারণে আপনি অতিরিক্ত খরচ করছেন—সেটা আমি বলতে পারি। আমি আপনাকে প্রমাণ করে দেখাতে পারি, কীভাবে আমি এই শহরের সবচেয়ে কঠিন পরিশ্রম করে টিকে আছি।”
রণজয় চৌধুরীর মুখে হাসি ফুটল। তিনি অয়নকে তিনটি জটিল সমস্যার সমাধান দিতে বললেন, যা তিনি গত ছয় মাসে তার সাপ্লাই চেইন নিয়ে মোকাবিলা করছিলেন।
অয়ন তার এক বছরের রাতের পড়াশোনা এবং বাজারের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এমন কিছু ব্যবহারিক এবং কার্যকর সমাধান দিল, যা ডিগ্রিধারী অন্য কোনো প্রার্থী দিতে পারেনি।
ইন্টারভিউ শেষে রণজয় চৌধুরী অন্য সব প্রার্থীকে বিদায় দিলেন। শুধু অয়নকে রেখে দিলেন।
“তোমার নাম অয়ন, তাই না?” রণজয় চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন। “তোমার শিক্ষাগত যোগ্যতা শূন্য, কিন্তু তোমার চিন্তাভাবনা এই রুমে থাকা বাকি সবার চেয়ে দশগুণ বেশি মূল্যবান। কেন এত আগ্রহ তোমার এই কাজে?”
অয়ন দ্বিধা না করে বলল, “আমার জীবনে একজন মানুষকে প্রমাণ করার আছে, যে দারিদ্র্যের কারণে ভালোবাসা হারাতে হয় না। আমি জীবনে এমন উচ্চতায় পৌঁছাতে চাই, যেখানে আমার পকেটের শূন্যতা কেউ দেখতে না পায়।”
রণজয় চৌধুরী কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। তারপর তিনি হেসে উঠলেন।
“ঠিক আছে, অয়ন। আমি তোমাকে একটা সুযোগ দিচ্ছি। তোমাকে এই মুহূর্তে কোনো বড় পদ দিতে পারব না, কিন্তু তুমি আমার ফ্যাক্টরির সবচেয়ে নিচের পদে যোগ দিতে পারো। তোমার কাজ হবে সব কর্মীর সঙ্গে মিশে সমস্যাগুলো খুঁজে বের করা এবং সেগুলোর সহজ সমাধান আমাকে জানানো। তোমার বেতন হবে সবার চেয়ে কম। তুমি কি রাজি?”
অয়ন যেন আকাশ ছুঁয়ে গেল। “আমি রাজি, স্যার। আমাকে একটা সুযোগ দিন। আমি আপনাকে প্রমাণ করে দেব, আপনার এই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না।”
এইভাবে অয়ন তার জীবনের এক নতুন, কঠিন সংগ্রামে প্রবেশ করল। সে এখন রণজয় চৌধুরীর ফ্যাক্টরির একজন সামান্য কর্মী, কিন্তু তার চোখে এখন জ্বলছে সাফল্যের তীব্র শিখা।
ফ্যাক্টরির নোংরা, কঠিন পরিবেশে কাজ শুরু করল অয়ন। দিনভর কাজ, রাতে বই এবং অফিসের সমস্যার বিশ্লেষণ—এই ছিল তার রুটিন। সে ছিল একজন সাধারণ শ্রমিক, কিন্তু তার মস্তিষ্ক ছিল এক কর্পোরেট কৌশলীর মতো সক্রিয়।
একদিন রাতে, কাজ শেষে অফিসের একটি কোণে বসে অয়ন শ্রেয়ার দেওয়া চাবির রিংটা দেখল। রিংটা ছিল তার একমাত্র অনুপ্রেরণা।
ঠিক সেই সময়, একটি পুরোনো খবরের কাগজ তার চোখে পড়ল। সেটা ছিল শহরের এক সমাজসেবামূলক অনুষ্ঠানের খবর। সেখানে ধনী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ভিড়ে শ্রেয়ার মুখটি সে দেখতে পেল। শ্রেয়া দেশে ফিরে এসেছে!
শ্রেয়ার ছবির নিচে লেখা ছিল, ‘শ্রেয়া রায়, সদ্য বিদেশ থেকে ফেরা, তার বাবার এনজিও-এর কাজ দেখাশোনা করছেন।’
অয়নের বুকটা কেঁপে উঠল। সে ফিরে এসেছে! হয়তো সে তার জীবন থেকে অয়নকে মুছে ফেলেছে।
অয়ন জোরে নিঃশ্বাস নিল। এখন আর হতাশ হওয়ার সময় নেই। সে তার সংকল্পে স্থির।
“তুমি ফিরে এসেছো, শ্রেয়া,” অয়ন মনে মনে বলল। “খুব ভালো। এবার আমি এমনভাবেই তোমার সামনে যাব, যাতে তোমার বাবাও আমার দিকে শ্রদ্ধার চোখে তাকাতে বাধ্য হন। আমার সংগ্রাম কেবল শুরু হলো।”
অয়নের চোখে ছিল নতুন উদ্যম, নতুন সংকল্প। তার জীবনের সাফল্যের মঞ্চ প্রস্তুত হচ্ছে।
