প্রেমিকের শূন্য পকেট (পর্ব-৩)

শ্রেয়া চলে যাওয়ার পর এক মাস। বাজারের চা-দোকান আর গ্যারেজের কাজ, সবকিছুতেই অয়নের মন অনুপস্থিত। তার চোখ এখন আর ফুলের দোকানে শ্রেয়াকে খোঁজে না, বরং তার চোখ যেন সমাজের প্রতিটি ধনী মানুষের চোখে শ্রেয়ার বাবার তাচ্ছিল্য খুঁজে বেড়ায়।

শ্রেয়ার দেওয়া বিদায়ী চিঠিটা অয়ন রোজ রাতে পড়ত। চিঠিটা তার কাছে ভালোবাসার শেষ স্মৃতি নয়, বরং ছিল তার ব্যর্থতার এক জ্বলন্ত দলিল। তার ভালোবাসা কেন হার মানল? কারণ তার পকেট শূন্য ছিল। কারণ তার সামাজিক ভিত্তি দুর্বল ছিল।

অয়ন একদিন রাতে তার ঘরে বসেছিল। চারদিকে দারিদ্র্যের ছাপ, দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে। সে তার হাতে ধরা বইগুলো দেখল—রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ। একসময় এই বইগুলো ছিল তার স্বপ্ন, তার সান্ত্বনা। কিন্তু আজ সে বুঝতে পারল, এই সমাজ তাকে সাহিত্যিক বা স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে নয়, কেবল একজন গরিব চা-ওয়ালা হিসেবেই দেখবে।

হঠাৎ অয়নের ভেতর থেকে সব আবেগ উধাও হয়ে গেল। জন্ম নিল এক নতুন, কঠিন সংকল্প। এই ব্যর্থতা তাকে ভেঙে দিল না, বরং তাকে ইস্পাতের মতো শক্ত করে তুলল।

সে স্থির করল, সে তার জীবনের লক্ষ্য পাল্টে দেবে। এখন তার লক্ষ্য শুধু স্বপ্ন দেখা নয়, এখন তার লক্ষ্য হবে সম্পদ অর্জন করা। এমন সম্পদ, যা সমাজের উঁচু-নিচু ভেদ ঘুচিয়ে দিতে পারে, যা শ্রেয়ার বাবার মতো মানুষের তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি চিরতরে নামিয়ে দিতে পারে।

পরের দিন সকালে, অয়ন চা-দোকানের মালিকের কাছে গেল। মালিক একজন বৃদ্ধ, যিনি অয়নকে ছেলের মতো ভালোবাসতেন।

“কাকা, আমি আর এই কাজটা করতে পারছি না,” অয়ন বলল।

বৃদ্ধ কাকা অবাক হলেন। “কী বলছিস তুই? শরীর খারাপ? নাকি অন্য কোনো সমস্যা?”

“না, কাকা। আমি শহর ছাড়ব। আরও বড় কাজ খুঁজতে যাব।”

কাকা অয়নের চোখের দিকে তাকালেন। সেখানে এক ধরনের শূন্যতা ছিল, কিন্তু তার ভেতরে চাপা ছিল এক নতুন আগুন।

“প্রেমে ব্যর্থ হলে মানুষ ভেঙে যায়, কিন্তু তুই দেখছি নতুন করে গড়তে চাইছিস,” বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “শোন বাবা, টাকা সব নয়। কিন্তু এই নিষ্ঠুর দুনিয়ায় টাকা ছাড়া কিছু হয়ও না। যদি যেতেই চাস, তবে যা। কিন্তু ভুলে যাস না, তোর কাকার দোকান তোর জন্য সবসময় খোলা।”

অয়ন চায়ের দোকানের কাকার কাছে ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিল। তার জীবনের একমাত্র অবলম্বন ছিল এই দুটো কাজ। এখন সে দুটোই ছেড়ে দিল। যাওয়ার আগে সে শুধু তার পুরোনো সাইকেলটা বিক্রি করে দিল, যাতে কিছু টাকা হাতে আসে।

<h4>অধ্যায় ৯: শহর ছাড়ার মুহূর্ত</h4>

অয়ন বাড়ি ফিরে তার ছোট বোন আর মাকে সব খুলে বলল।

“মা, আমি চলে যাচ্ছি। আমি জানি না কবে ফিরব। কিন্তু আমি ফিরে আসব, যখন আমাদের এই দারিদ্র্য থাকবে না,” অয়ন আবেগ ধরে বলল।

অয়নের মা তাকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি জানতেন, তার ছেলে শুধু একটি প্রেম হারায়নি, সে সমাজের কাছে হেরেছে। তাই তিনি বাধা দিলেন না।

“সাবধানে থাকিস, বাবা। আমাদের জন্য চিন্তা করিস না। তোর স্বপ্ন পূরণ করে তবেই ফিরিস।”

ছোট বোনটি অয়নের হাত ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। অয়ন তাকে শান্ত করে বলল, “তোর জন্য আমি এমন জীবন তৈরি করব, যেখানে তোর কোনো স্বপ্ন অপূর্ণ থাকবে না।”

অয়ন তার কাঁধে একটি পুরোনো ব্যাগ ঝোলাল। ভেতরে কিছু জামাকাপড়, কয়েকটা বই, আর শ্রেয়ার বিদায়ী চিঠিটা। সেই চিঠিটা ছিল তার জীবনের নতুন ‘মোটিভেশন’—ব্যর্থতা থেকে উঠে আসার সংকল্প।

সে ট্রেনে চড়ল। তার পকেটে তখন মাত্র কয়েকশ টাকা। কোথায় যাবে, কী করবে—সে জানে না। সে কেবল জানে, তার আর পেছনে ফিরে তাকানোর উপায় নেই।

ট্রেন তাকে নিয়ে এল এক অচেনা, বিশাল শিল্প শহরে। এই শহরের রাস্তাগুলো আরও দ্রুত, মানুষগুলো আরও ব্যস্ত, আর প্রতিযোগিতা আরও ভয়াবহ।

এখানে এসে অয়ন বুঝতে পারল, তার সাধারণ শিক্ষা আর সামান্য অভিজ্ঞতা এই শহরে কোনো কাজে আসবে না। দিন দুয়েক স্টেশনের বাইরে থাকার পর, সে একটি নির্মাণাধীন ভবনে কুলির কাজ পেল।

কাজটা ছিল শরীরের সাথে যুদ্ধ করার মতো। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কংক্রিট, বালু আর রডের ভার বইতে হতো। যে হাত একসময় আলতো করে বইয়ের পাতা উল্টাত, সেই হাতে এখন ফোস্কা। কিন্তু অয়ন একবারের জন্যও অভিযোগ করল না। সে এই শারীরিক কষ্টকে তার মনের কষ্টের চেয়ে তুচ্ছ মনে করল।

প্রতিটি রড তোলার সময় সে ভাবত—এই ভার শুধু রডের নয়, এটা শ্রেয়ার বাবার তাচ্ছিল্যের ভার। প্রতিটি ঘামের ফোঁটা যেন তার সংকল্পকে আরও বেশি পরিশুদ্ধ করত।

এই নতুন শহরে, অয়ন আর স্বপ্নদ্রষ্টা ছিল না। সে ছিল এক লড়াকু, যে তার শূন্য পকেটকে ঘৃণা করে, আর তাই টাকা ও সাফল্যের জন্য প্রতিজ্ঞা করে কঠোর সংগ্রাম করছে।

একদিন রাতে, কাজ শেষে এক কোণে শুয়ে অয়ন শ্রেয়ার চিঠিটা বের করল। চাঁদের আবছা আলোয় চিঠিটা পড়ে সে নিঃশব্দে ফিসফিস করে বলল:

“শ্রেয়া, তুমি চেয়েছিলে আমি যেন তোমাকে ভুলে যাই। আমি তা করব না। আমি তোমাকে মনে রাখব। কারণ তোমার বিদায়ই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। আমি এমনভাবে ফিরে আসব, যাতে তোমার বাবা আর সমাজ—কেউই আমাদের ভালোবাসার দাম নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে।”

(চলমান)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *