শ্রেয়ার বাবার হাতে ধরা পড়ার পর এক সপ্তাহ কেটে গেছে। অয়ন আর শ্রেয়ার দেখা হয়নি। অয়ন রোজ চায়না, তবুও সে গোপনে অপেক্ষা করে। চা-দোকানে বসে তার চোখ বারবার বাজারের ফুলের দোকানের দিকে চলে যায়। কিন্তু শ্রেয়া আসেনি।
একদিন রাতে, অয়ন তার পুরোনো, ভাঙা মোবাইল ফোনে একটি অচেনা নম্বর থেকে টেক্সট ম্যাসেজ পেল। প্রেরক – শ্রেয়া।
শ্রেয়া: তোমার সাথে দেখা করা খুব জরুরি। কাল সকালে পুরোনো লাইব্রেরির পাশে যে ভাঙা কফি শপটা আছে, সেখানে এসো। কেউ যেন না জানে।
অয়নের বুকের ভেতরটা ধুকপুক করে উঠল। সে জানে, এই দেখা হয়তো শেষ দেখা।
পরের দিন সকালে, লাইব্রেরির কাছে সেই ভাঙা কফি শপে অয়ন অপেক্ষা করছিল। কফি শপটি প্রায় ফাঁকা। কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্রেয়া এল। তার চোখে ছিল গভীর কালি, মুখে কোনো হাসি নেই। সে যেন এক সপ্তাহের মধ্যেই অনেক পাল্টে গেছে।
শ্রেয়া বসেই সরাসরি কথা শুরু করল, কোনো ভূমিকা ছাড়াই।
“আমার বাবা জানতে পেরেছেন, অয়ন। তিনি তোমাকে দেখেছেন।”
অয়ন মাথা নিচু করল। “আমি দুঃখিত। আমি চাইনি এভাবে…”
“না, তুমি দুঃখিত হয়ো না। দোষ আমারই,” শ্রেয়া বলল। “আমি তোমাকে কখনও আমার জীবনের আসল পরিস্থিতি বুঝতে দিইনি। বাবার রাগটা স্বাভাবিক। তিনি জানতে পেরেছেন তুমি কী কাজ করো, আর আমাদের দুজনের সামাজিক অবস্থান কতটা আলাদা।”
শ্রেয়া তার ব্যাগ থেকে একটি মোটা খাম বের করে টেবিলে রাখল।
“বাবা চায় না আমি তোমার সাথে আর যোগাযোগ রাখি। তিনি আমার জন্য বিদেশে পড়ালেখার ব্যবস্থা করেছেন। আগামী সপ্তাহে আমার ফ্লাইট।”
অয়ন খামটার দিকে তাকাল, সেটা হয়তো টাকা, অথবা শুধু বিদায়ের বার্তা। অয়ন খামটা স্পর্শও করল না।
অয়ন হঠাৎ মাথা তুলল। তার চোখে ছিল এক স্থির দৃঢ়তা।
“আমি এটা বিশ্বাস করি না, শ্রেয়া। তোমার বাবা কী চান, সেটা বড় কথা নয়। তুমি কী চাও? তুমি কি আমার ভালোবাসার বিনিময়ে তোমার বাবার দেখানো পথটা বেছে নেবে? তুমি বলেছিলে, তুমি আমাকে চাও, টাকা নয়।”
শ্রেয়ার চোখ ছলছল করে উঠল। “অয়ন, তুমি বুঝছো না। এটা শুধু টাকার ব্যাপার নয়। আমার বাবা আমাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, আমি যদি তোমার সাথে সম্পর্ক রাখি, তবে তিনি আমার ছোট ভাইয়ের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেবেন, পারিবারিক ব্যবসা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবেন। তিনি আমার দুর্বলতম স্থানে আঘাত করেছেন।”
“আমি তোমার পরিবারের জন্য কোনো বোঝা হতে চাই না, কিন্তু আমি তোমার জন্য সব করতে রাজি। আমাকে এক বছর সময় দাও,” অয়ন আকুলভাবে বলল। “আমি দিন-রাত কাজ করব। আমি তোমার যোগ্য হওয়ার জন্য সব করব। আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করব।”
শ্রেয়া কাঁপা কাঁপা হাতে তার হাত ধরল। “আমি জানি, অয়ন। আমি জানি তুমি সফল হবে। কিন্তু এই এক বছরে আমি কোথায় থাকব? তুমি কি সত্যিই মনে করো, আমার বাবা অপেক্ষা করবেন? তিনি এই ব্যবধানটাকে ব্যবহার করবেন, যাতে আমরা একে অপরের থেকে আরও দূরে সরে যাই।”
অয়ন নিঃশব্দে টেবিলের দিকে তাকাল। সে অনুভব করল, শুধু প্রেম বা আবেগ দিয়ে পৃথিবীর কঠিন বাস্তবতাকে জয় করা যায় না। তার ভালোবাসা তার পকেটের মতো শূন্য না হলেও, তা যথেষ্ট শক্তিশালী নয় এই সমাজের তৈরি করা প্রাচীর ভাঙতে।
শ্রেয়া উঠে দাঁড়াল। তার চোখে জল।
“অয়ন, আমার পক্ষে তোমাকে ছেড়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই। এটা তোমার জন্য আমার শেষ উপহার,” বলে সে চোখের জল মুছে টেবিলের উপর রাখা খামটি অর্ণনের দিকে ঠেলে দিল। “এটা আমার পক্ষ থেকে একটা বিদায়ের চিঠি। এটা খুলো, যখন আমি এখান থেকে চলে যাব।”
শ্রেয়া আর একটি মুহূর্তও দাঁড়াল না। সে দ্রুত কফি শপ থেকে বেরিয়ে গেল। অয়ন তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল, কিন্তু তার পিছু নিল না। সে জানে, পিছু নেওয়া অর্থহীন।
শ্রেয়া চলে যাওয়ার পর, অয়ন কাঁপতে কাঁপতে সেই খামটি খুলল। ভেতরে কোনো টাকা ছিল না, ছিল কেবল একটি হাতে লেখা চিঠি এবং একটি ছোট, পুরোনো চাবির রিং—যা শ্রেয়া তাকে প্রথম বন্ধুত্বের দিনে উপহার দিয়েছিল।
চিঠিতে লেখা ছিল:
প্রিয় অয়ন,
আমি জানি তুমি আমাকে ভুল বুঝবে, কিন্তু আমার কোনো উপায় নেই। আমি তোমাকে আমার জীবনের সমস্ত কিছুর বিনিময়ে ভালোবাসি। কিন্তু আমার প্রেম আমার পরিবারের কাছে মাথা নত করেছে। আমি বিদেশে যাচ্ছি, তবে তোমাকে ভুলব না। আমি চাই, তুমি আমাকে ভুলে যাও। আমি চাই, তুমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করো। তুমি একদিন অনেক বড় হবে, আমি জানি। সেই দিন তুমি আমাকে খুঁজবে না, কারণ আমি সেই পুরোনো, দুর্বল শ্রেয়া থাকতে চাই না, যে তার ভালোবাসার জন্য লড়তে পারেনি।
তুমি আমাকে ভুলে যেও। তোমার জীবনে অন্য কেউ আসুক, যে তোমার যোগ্য। আমি সবসময় তোমার সুখ দেখতে চাই।
তোমার শ্রেয়া।
অয়ন সেই চিঠিটা দু হাতে চেপে ধরল। তার চোখ দিয়ে অনর্গল জল পড়ছিল। তার জীবনসংগ্রামের চেয়েও কঠিন এই ব্যর্থতা তাকে আজ আঘাত করল।
সে বুঝল, তার প্রেমিকার শূন্য পকেটে ভরা ভালোবাসা, সমাজের চোখে ছিল কেবল একটি ঠাট্টার পাত্র।
(চলমান)
