অয়ন (২২), এক দরিদ্র পরিবারের ছেলে। বাবা মারা যাওয়ার পর, সংসারের ভার তার কাঁধেই। সে শহরের এক পাইকারি সবজি বাজারে একটি ছোট চায়ের দোকানে কাজ করে, পাশাপাশি রাতে একটি গ্যারেজে পার্ট-টাইম কাজ করে। তার জীবন মানেই কেবল কাজ আর হিসেব—কীভাবে মাসটা পার হবে, কীভাবে ছোট বোনটার স্কুলের বেতন জুটবে।
অয়নের স্বপ্ন ছিল বড় কিছু করার, কিন্তু স্বপ্নগুলো কেবল শূন্য পকেটের ভারে চাপা পড়ে গেছে। তার একমাত্র ভালোলাগার বিষয় ছিল বই পড়া; পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে কম দামে বই কিনে সে রাতে সেগুলো পড়ত।
একদিন সকালবেলা। বাজারের কাছেই এক নামী কলেজের সামনে চায়ের দোকানে বেজায় ভিড়। সেখানেই সে প্রথম দেখল শ্রেয়া-কে। শ্রেয়া ধনী পরিবারের মেয়ে, পড়াশোনায় ভালো, ফ্যাশনেবল পোশাক আর তার হাসিতে যেন এক ঝলমলে আলো। শ্রেয়া তার বান্ধবীদের সাথে গল্প করতে করতে অয়নের চায়ের দোকানে এল।
“এক কাপ কফি, প্লিজ,” শ্রেয়া বলল। তার কণ্ঠস্বর ছিল নরম, কিন্তু সেখানে ছিল এক স্বাভাবিক আত্মবিশ্বাস, যা অয়নের কাছে ছিল অচেনা।
অয়ন কফি তৈরি করে পরিবেশন করল। এই প্রথম কোনো মেয়ের দিকে সে এতক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তার চোখ নামছিল না। এই চোখে কোনো স্বপ্ন ছিল না, ছিল শুধুই মুগ্ধতা।
শ্রেয়া প্রায় প্রতিদিনই বান্ধবীদের সাথে বাজারে আসত, তবে চায়ের দোকানে নয়। সে আসত পাশের একটি ফুলের দোকানে। অয়ন দূর থেকে তাকে দেখত। সে দেখতে পেত, শ্রেয়া হাসি-ঠাট্টার মধ্যেও মাঝে মাঝে বইয়ের দোকানে উঁকি দিচ্ছে।
একদিন সাহস করে অয়ন তার কাছে এগিয়ে গেল।
“আপনার জন্য একটা বই আছে,” অয়ন সংকোচের সাথে বলল। “আপনি পুরোনো বইয়ের দোকানে খুঁজছিলেন মনে হলো, তাই…”
শ্রেয়া অবাক হয়ে তাকাল। “তুমি? তুমি কি আমাকে দেখ…”
“না, মানে… আমি ওই চা-দোকানে কাজ করি। একটা বই দেখলাম আপনার পছন্দের, তাই…”
অয়ন তার হাতে রবীন্দ্রনাথের একটি পুরোনো কাব্যগ্রন্থ তুলে দিল। শ্রেয়ার চোখে এক ঝলক বিস্ময় দেখা গেল।
“তুমি জানো, আমার এই বইটি অনেক প্রিয়? তুমি জানলে কীভাবে?”
“আপনার চোখ দেখে,” অয়ন ফিসফিস করে বলল। “যখন আপনি বইয়ের দিকে তাকান, তখন আপনার চোখগুলো অন্যরকম উজ্জ্বল দেখায়।”
শ্রেয়া হাসল। সেই হাসি অয়নের মনের সমস্ত শূন্যতাকে পূর্ণ করে দিল। সেদিন থেকে তাদের মধ্যে একটা অদ্ভুত বন্ধুত্ব শুরু হলো। শ্রেয়া প্রতিদিন তার কাছে আসত, জীবন আর স্বপ্ন নিয়ে কথা বলত। অয়ন তার জীবনের সব দুঃখ, দারিদ্র্য লুকিয়ে রাখত। শ্রেয়ার কাছে সে কেবল এক স্বপ্নদ্রষ্টা ছিল, যে বই ভালোবাসে।
তাদের এই মিষ্টি বন্ধুত্ব দ্রুতই ভালোবাসায় পরিণত হলো। কিন্তু অয়ন জানত, এই ভালোবাসা টিকিয়ে রাখা তার পক্ষে অসম্ভব। শ্রেয়ার জীবন যেখানে আকাশ ছোঁয়, তার জীবন সেখানে মাটির নিচে।
একদিন সন্ধ্যায়, তারা শহরের পুরোনো এক পার্কে বসেছিল।
“অয়ন,” শ্রেয়া তার হাত ধরল। “তুমি আমার জীবনের সবকিছু। তুমি কি কোনোদিন আমাকে ছেড়ে যাবে না?”
অয়ন কোনো উত্তর দিতে পারল না। সে শ্রেয়ার হাত ধরল, কিন্তু তার চোখের দিকে তাকাতে পারল না।
“শ্রেয়া, আমাকে একটা কথা দাও,” অয়ন বলল। “আমার জীবনের পরিস্থিতি খুব কঠিন। আমি হয়তো তোমাকে সেই জীবন দিতে পারব না, যা তোমার প্রাপ্য।”
“আমি টাকা বা বিলাসবহুল জীবন চাই না, অয়ন। আমি তোমাকে চাই,” শ্রেয়া আবেগের সাথে বলল।
কিন্তু নিয়তি অন্য কিছু লিখে রেখেছিল।
একদিন, অয়ন যখন তার গ্যারেজের কাজ শেষে নোংরা পোশাকে বাড়ি ফিরছিল, তখন সে দেখল—শ্রেয়া তাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন একজন রাশভারী, বয়স্ক ভদ্রলোক—শ্রেয়ার বাবা।
শ্রেয়ার বাবা অর্ণবের দিকে এক ঝলক তাকালেন। সেই দৃষ্টিতে ছিল তীব্র ঘৃণা, তাচ্ছিল্য এবং অবজ্ঞা।
“শ্রেয়া,” তার বাবা বললেন। “এই তোমার সেই ‘স্বপ্নদ্রষ্টা’?”
শ্রেয়ার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অয়ন তার ছেঁড়া স্যান্ডেল এবং তেল-কালি মাখা হাত লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করল। শ্রেয়ার বাবা অয়নকে কিছু বললেন না, কেবল শ্রেয়ার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন।
যাওয়ার আগে শ্রেয়া কেবল অয়নকে একবার দেখল। সেই চোখে ছিল গভীর বেদনা আর অসহায়তা। সেই রাতে অয়ন বুঝতে পারল, তাদের ভালোবাসার সামনে তার শূন্য পকেট আর সমাজের উঁচু-নিচুর দেয়াল আকাশ ছুঁয়ে গেছে।
