নিশীথ রাতের অতিথি (পর্ব-৬)

সুরঞ্জন মুখার্জীর গ্রেপ্তারির পর ‘ব্ল্যাক লোটাস’ চক্রের মেরুদণ্ড ভেঙে গেলেও, অরুণিমা ভট্টাচার্যের মতে, মূল মাথাটি এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই প্রধান নেতাকে তারা ডাকতেন কেবল ‘ওভারলর্ড’ নামে।

সুরঞ্জনের অফিস থেকে উদ্ধার হওয়া একটি এনক্রিপ্টেড ফাইল এবং কিছু স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করে অরুণিমা এবং অর্ণব একটি নতুন সূত্র পেলেন। ওভারলর্ড-এর পরবর্তী মিটিং হবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত একটি বৌদ্ধ মঠের কাছে।

“ওভারলর্ড একজন সাধু বা সন্ন্যাসীর বেশে লুকিয়ে থাকতে পারে,” অরুণিমা বললেন। “সুরঞ্জনের নোট অনুযায়ী, তাদের শেষ লেনদেন হবে ‘শান্তির শিখরে’। আর এই শান্তিনগরে একটি পুরোনো মঠ আছে—নিরাভরণ মঠ।”

“কিন্তু সেখানে কীভাবে যাব?” অর্ণব জানতে চাইল। “সেখানে সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই।”

“আমাদেরকে একজন ধর্মীয় পর্যটকের বেশে যেতে হবে। তোমাকে একটি নতুন পরিচয় নিতে হবে—বিক্রম চৌধুরী, একজন ভ্রমণ লেখক, যিনি দুর্গম মঠগুলো নিয়ে ডকুমেন্টারি তৈরি করেন,” অরুণিমা পরিকল্পনা বললেন।

কয়েক দিনের প্রস্তুতি শেষে অর্ণব এবং অরুণিমা নেপালের সীমান্তবর্তী এক ছোট শহরে পৌঁছালেন। সেখান থেকে তাদের পায়ে হেঁটে দুর্গম পাহাড়ি পথে নিরাভরণ মঠের দিকে যেতে হবে।

ভ্রমণটি ছিল কষ্টকর। তীব্র শীত, চড়াই-উতরাই এবং অক্সিজেনের অভাব অর্ণবকে কাহিল করে তুলছিল। অরুণিমা যদিও সামরিক প্রশিক্ষণের কারণে বেশি শক্ত ছিলেন, তবুও তিনিও ক্লান্ত।

পথে তাদের সাথে দেখা হলো একদল পর্যটকের, কিন্তু অর্ণবের নজর গেল তাদের দলের এক শান্ত, সৌম্য চেহারার বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর দিকে। সন্ন্যাসীর চোখজোড়া ছিল অদ্ভুত রকমের তীক্ষ্ণ। অর্ণবের মনে হলো, যেন তিনি অর্ণবকে চিনতে পারছেন।

মঠের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর, মঠের প্রধান লামা তাদের সাদরে গ্রহণ করলেন। অর্ণব তার সাংবাদিকতার পরিচয় দিয়ে মঠের জীবনধারা নিয়ে জানতে চাইল। মঠের ভেতরে ছিল এক গভীর শান্তি—যা বাইরের জগতের সব কোলাহলকে ভুলিয়ে দেয়।

কিন্তু অর্ণবের মন মানছিল না। সে জানত, এই শান্তির আড়ালেই লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর অপরাধী।

রাতে, যখন সবাই ঘুমিয়ে, অর্ণব গোপনে মঠের ভেতরে অনুসন্ধান শুরু করল। তার লক্ষ্য ছিল লামাদের প্রধান কার্যালয়।

দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর, অর্ণব প্রধান লামার কার্যালয়ের একটি পুরোনো পাথরের বুদ্ধ মূর্তির নীচে একটি সূক্ষ্ম ফাটল খুঁজে পেল। ফাটলের কাছে কান পেতে সে ক্ষীণ যান্ত্রিক শব্দ শুনতে পেল।

সে অরুণিমাকে ডেকে আনল। অরুণিমা দ্রুত তার কাছে থাকা বিশেষ সরঞ্জাম দিয়ে মূর্তিটি সরালেন। নিচে একটি গোপন দরজা!

দরজাটি খুলে তারা দেখতে পেলেন, নিচে একটি আধুনিক কন্ট্রোল রুম। ভেতরে কম্পিউটার, স্যাটেলাইট ফোন এবং মনিটরের ভিড়। আর সেখানে বসে আছেন দুইজন—এক জন বিদেশী এবং সেই সন্ন্যাসী, যাকে অর্ণব পথে দেখেছিল।

সন্ন্যাসীই ছিল ওভারলর্ড! তার সৌম্য চেহারার আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রের মূল মাথা।

ওভারলর্ড হাসলেন। “আমি জানতাম, তোমরা এখানে আসবে। আমি তোমাদের অভ্যর্থনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”

অর্ণব এবং অরুণিমা হতবাক। ওভারলর্ড কীভাবে জানতেন?

“রিমি খুব চালাক ছিল,” ওভারলর্ড বললেন। “কিন্তু সে তোমার চেয়েও বেশি চালাক ছিল। সে জানত, আমাকে ধরতে হলে আমার চাল বুঝতে হবে। আমি তাকে মারিনি, অর্ণব। সে নিজেই মারা গিয়েছিল—আমার হাতে ধরা পড়ার চেয়ে সে মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছিল। কিন্তু তার আগে সে তোমার জন্য একটি বার্তা রেখে গিয়েছিল।”

ওভারলর্ডের কথা শুনে অর্ণব স্তব্ধ হয়ে গেল।

“রিমি জানত,” ওভারলর্ড একটি ছোট রিমোট কন্ট্রোল দেখিয়ে বললেন, “এই ঘরে একটি বোমা পাতা আছে। যদি কেউ এর কাছাকাছি আসে, তবে সেটি সক্রিয় হয়ে যাবে।”

“তুমি কী চাও?” অরুণিমা তার অস্ত্র বের করতে গিয়েও থেমে গেলেন, কারণ ওভারলর্ডের হাতে ছিল রিমোট।

“আমি কিছুই চাই না,” ওভারলর্ড বললেন। “কারণ আমি ইতিমধ্যেই সব পেয়ে গেছি। আমাদের পরবর্তী চালের জন্য সব ব্যবস্থা করা আছে। কিন্তু তোমরা এখানে থেকে গেলে, আমার শান্তি বিঘ্নিত হবে।”

হঠাৎ ওভারলর্ডের বিদেশী সঙ্গীটি অর্ণবের দিকে গুলি ছুঁড়ল। অরুণিমা দ্রুত অর্ণবকে ঠেলে দিলেন। গুলিটি দেয়ালে আঘাত করল।

এই সুযোগে অর্ণব একটি পুরোনো দিনের সামরিক কৌশল ব্যবহার করল—সে তার হাতের টর্চলাইটটি ঘুরিয়ে বিদেশী লোকটির চোখে ছুঁড়ল। লোকটি সাময়িকভাবে অন্ধ হয়ে গেল।

অরুণিমা সঙ্গে সঙ্গে তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

ওভারলর্ড দ্রুত রিমোট কন্ট্রোল টিপে দিলেন। “সময় শেষ! তোমাদের জীবনের চিত্রনাট্য এখানেই শেষ!”

তীব্র শব্দে রুমের এক কোণে বিস্ফোরণ হলো। কন্ট্রোল রুমের বিদ্যুৎ চলে গেল। চারদিকে অন্ধকার।

অর্ণব লাফ দিয়ে ওভারলর্ডের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। রিমোট কন্ট্রোলটি হাতছাড়া হয়ে গেল।

“আমার স্ত্রীর নাম মুখে আনবেন না!” অর্ণব চিৎকার করল।

অর্ণব এবং ওভারলর্ডের মধ্যে শুরু হলো মরণপণ লড়াই। তারা দুজনেই শারীরিক দিক থেকে সমান না হলেও, অর্ণবের চোখে ছিল প্রতিশোধের আগুন।

একসময় অর্ণব ওভারলর্ডকে ধাক্কা মেরে কন্ট্রোল রুমের একটি কাঁচের আলমারির ওপর ফেলে দিল। আলমারি ভেঙে কাঁচের টুকরোগুলো ওভারলর্ডের শরীরে বিঁধে গেল। সে মারাত্মকভাবে আহত হলো।

পুলিশ এবং মঠের লামারা দৌড়ে এলেন।

ওভারলর্ড গ্রেপ্তার হলেন। তার গ্রেপ্তারের সঙ্গে সঙ্গে ‘ব্ল্যাক লোটাস’ চক্রের আন্তর্জাতিক জাল সম্পূর্ণরূপে ভেঙে গেল।

অর্ণব এবং অরুণিমা মঠের বাইরে বেরিয়ে এলেন। সূর্যের আলোয় পুরো হিমালয় আলোকিত।

অর্ণবের দিকে তাকিয়ে অরুণিমা বললেন, “তুমি এখন আর নীল রায় বা অর্ণব সেন নও। তুমি একজন নায়ক। তুমি তোমার স্ত্রীর অপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করেছ।”

অর্ণব মাথা নেড়ে হাসল। তার মনে আজ কোনো বিদ্বেষ নেই, আছে এক গভীর শান্তি। সে রিমির দেওয়া সমস্ত কষ্ট এবং চ্যালেঞ্জকে জয় করে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।

অর্ণব বলল, “আমার জীবনের এই রোমাঞ্চের চিত্রনাট্য আমিই লিখতে চাই, যেখানে প্রতি অধ্যায়ে সত্যের জয় হবে।”

অর্ণব এখন একজন এজেন্ট, একজন রক্ষক। তার সামনে আরও অনেক রহস্য এবং রোমাঞ্চ অপেক্ষা করছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *