নিশীথ রাতের অতিথি (পর্ব-৫)

মাসখানেক পেরিয়ে গেছে। শৈলশিখা বাংলো এখন তালাবদ্ধ। অর্ণব সেন তার লেখালিখির জীবন থেকে পুরোপুরি সরে এসে কলকাতার এক সুরক্ষিত গোপন আস্তানায় আশ্রয় নিয়েছে। অর্ণবের জীবনে এখন একটাই সঙ্গী—অরুণিমা ভট্টাচার্য।

মাইক্রোফিল্মের তথ্য ফাঁস হওয়ার পর দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। ‘ব্ল্যাক লোটাস’-এর অনেক সদস্য ধরা পড়লেও, তাদের মূল পৃষ্ঠপোষকরা এখনও ছায়ার আড়ালে। অরুণিমা ভট্টাচার্য তার ব্যক্তিগত গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ‘প্রোটেক্টর’ দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন এবং অর্ণব এখন সেই দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। অর্ণব তার লেখার ক্ষমতা এবং তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে চক্রের পুরোনো নথি ও চিঠিপত্র বিশ্লেষণ করছে।

একদিন সকালে, অরুণিমা অর্ণবের হাতে একটি ফাইল তুলে দিলেন।

“অর্ণব,” অরুণিমা বললেন, “আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য, ‘ব্ল্যাক লোটাস’-এর প্রধান আর্থিক মদতদাতা—বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সুরঞ্জন মুখার্জী।”

অর্ণব অবাক হয়ে বলল, “সুরঞ্জন মুখার্জী? যিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন? তার ছবি তো সমাজ পরিবর্তনের কথা বলে!”

“ঠিক সেখানেই সমস্যা,” অরুণিমা চোখ কুঁচকে বললেন। “সুরঞ্জনের সিনেমার আড়ালে বিশাল কালো টাকা সাদা করা হয়। আর সম্প্রতি, সুরঞ্জন একটি নতুন সিনেমার কাজ শুরু করেছেন—নাম ‘অন্ধকার যাপন’। আমাদের সন্দেহ, এই সিনেমার চিত্রনাট্যের মধ্যেই তাদের পরবর্তী পাচারের পরিকল্পনা লুকানো আছে।”

অর্ণব বলল, “তার মানে আমাকে একজন… অভিনেতা বা চিত্রনাট্যকার হিসেবে তার দলে ঢুকতে হবে?”

“ঠিক তাই। তোমার পরিচিতি গোপন রাখা জরুরি। তাই তোমাকে আমরা এক নতুন পরিচয়ে সুরঞ্জনের প্রোডাকশন হাউসে পাঠাচ্ছি—নাম হবে নীল রায়, একজন উঠতি সাংবাদিক, যে সুরঞ্জনের বায়োপিক লেখার সুযোগ খুঁজছে।”

অর্ণব ওরফে নীল রায় নিজেকে একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী সাংবাদিক হিসেবে সুরঞ্জনের কাছে উপস্থাপন করল। সুরঞ্জন মুখার্জী ছিলেন একজন শিল্পীসুলভ কিন্তু অত্যন্ত অহংকারী মানুষ। তিনি সহজেই নীলের কথায় রাজি হলেন।

নীল প্রোডাকশন হাউসের মধ্যে প্রবেশ করল। চারিদিকে ঝলমলে আলো, ক্যামেরার সরঞ্জাম, আর শিল্পীদের ব্যস্ততা। কিন্তু এই গ্ল্যামারের আড়ালে নীল খুঁজছিল অন্ধকার।

সুরঞ্জনের ঘনিষ্ঠ সহকারীরা কেউই স্বাভাবিক ছিল না। তাদের চোখ ছিল তীক্ষ্ণ এবং সতর্ক। নীল দ্রুত বুঝতে পারল, সুরঞ্জনের অফিসটি আসলে একটি কন্ট্রোল রুম।

নীলের কাজ ছিল সুরঞ্জনের নতুন সিনেমা ‘অন্ধকার যাপন’-এর চিত্রনাট্য খুঁটিয়ে দেখা। চিত্রনাট্যটি ছিল একটি প্রাচীন রহস্য নিয়ে, যেখানে মূল চরিত্র একটি মূল্যবান মূর্তি উদ্ধারের চেষ্টা করে।

নীল প্রথম সপ্তাহেই কিছু অসঙ্গতি খুঁজে পেল। চিত্রনাট্যের কিছু সংলাপ বা স্থানের বর্ণনা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বিস্তারিত ছিল।

  • একটি দৃশ্যে বলা হয়েছে: “সন্ধ্যা ৬:৩০৩৪৭ নং লেনের গোধূলি রঙের বাড়িটিতে দেখা হবে।”

  • আরেকটি দৃশ্যে একটি স্থানের বর্ণনা: “দ্বিতীয় স্তম্ভের নীচে, যেখানে নক্ষত্রের মতো জল ঝিলমিল করে।”

নীল বুঝতে পারল, এই সংখ্যা, রং এবং বিশেষ শব্দগুলো আসলে কোড হতে পারে।

নীল যখন গভীর রাতে তার আস্তানায় ফিরে এই কোডগুলো অরুণিমাকে বোঝাচ্ছিল, ঠিক তখনই সে একটি ফোন পেল। ফোনটি সুরঞ্জনের ব্যক্তিগত সহকারী সুমিতের।

“নীলদা, আপনি কোথায়? পরিচালক আপনাকে জরুরি তলব করেছেন। একটা দৃশ্য নিয়ে সমস্যা হয়েছে, আপনাকে এক্ষুনি সেটে আসতে হবে,” সুমিতের কণ্ঠে ছিল চাপা উত্তেজনা।

নীল বুঝতে পারল, এটা একটা ফাঁদ হতে পারে। সে অরুণিমাকে দ্রুত বিষয়টি জানিয়ে সেটের দিকে রওনা হলো।

শ্যুটিং হচ্ছিল শহরের উপকণ্ঠে একটি পুরোনো, পরিত্যক্ত ইটের ভাটায়। জায়গাটা ছিল নিস্তব্ধ এবং ভৌতিক।

নীল যখন সেটে পৌঁছাল, দেখল সেখানে কোনো ক্যামেরার আলো নেই, নেই কোনো শিল্পী বা কলাকুশলী। কেবল সুরঞ্জন একা দাঁড়িয়ে আছেন, তার হাতে একটি মদের গ্লাস।

“এসেছো, নীল রায়,” সুরঞ্জন হেসে বললেন। “আসলে তোমার ভেতরের আসল মানুষটাকে আমার পছন্দ হয়েছিল—অর্ণব সেন। তুমি এত ভালো অভিনয় করতে পারো, আমি মুগ্ধ। কিন্তু তুমি ভুলে গেছো, আমি একজন পরিচালক। অভিনেতাদের শরীরী ভাষা আমি সবার চেয়ে ভালো বুঝি।”

সুরঞ্জনের চোখ ছিল শীতল এবং হিংস্র। “তুমি ভেবেছিলে, আমার চিত্রনাট্য চুরি করে ‘ব্ল্যাক লোটাস’-এর রহস্য ভেদ করবে? তুমি রিমির ভুলটাই করেছো।”

সুরঞ্জনের ইশারায় পিছন থেকে চারজন লোক বেরিয়ে এল। তাদের হাতে অস্ত্র।

অর্ণব নিজেকে রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত হলো। সে বুঝতে পারল, তার একমাত্র বাঁচার উপায় হলো দ্রুত চিন্তা করা।

“আপনার সিনেমা হিট হবে না, সুরঞ্জন,” অর্ণব শান্তভাবে বলল। “আপনার চিত্রনাট্যের শেষটা দুর্বল। আপনি সবসময় রহস্যকে অন্ধকারেই রাখতে চান, কিন্তু দিনের আলোয় আসতে দেন না।”

সুরঞ্জন রেগে গেলেন। “চুপ করো! ওকে ধরো!”

যখন লোকগুলো অর্ণবের দিকে এগিয়ে এল, অর্ণব দ্রুত তার পকেট থেকে একটি বিশেষ ডিভাইস বের করে সুইচ অন করল। এটা ছিল অরুণিমার দেওয়া একটি অতি ক্ষুদ্র ফ্রিকোয়েন্সি জ্যামার।

পুরোনো ইটের ভাটার আশেপাশে থাকা সমস্ত ইলেকট্রনিক সিগন্যাল হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেল—সুরঞ্জনের লোকজনের ওয়াকি-টকি, এমনকি সুরঞ্জনের হাতে থাকা দামি স্মার্টফোনটিও।

ঠিক তখনই, চারপাশ থেকে তীব্র গতিতে ধেয়ে এল পুলিশ এবং প্রোটেক্টর দলের সদস্যরা। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন অরুণিমা ভট্টাচার্য।

“কাট! কাট!” অরুণিমা চিৎকার করলেন। “সুরঞ্জন মুখার্জী, আপনার ‘অন্ধকার যাপন’ এখানেই শেষ। আপনি এখন পুলিশের হেফাজতে।”

সুরঞ্জন হতবাক হয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারেননি, তার সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় তিনি বাইরের জগতে খবর পাঠাতে পারেননি।

অরুণিমা অর্ণবের দিকে তাকালেন। “চিত্রনাট্য অনুযায়ী অ্যাকশন শুরু। কিন্তু এবার তুমি নায়ক।”

অর্ণব হালকা হাসল। “কোডগুলো কাজ করেছে, অরুণিমা। ৬:৩০ ছিল গ্রেপ্তারের সময়, ৩৪৭ ছিল সুরঞ্জনের জিপের নম্বর, আর গোধূলি ছিল লোকেশনের নাম। সিনেমা আসলে তাদের অপরাধের নির্দেশিকা ছিল।”

সুরঞ্জন মুখার্জীকে গ্রেপ্তার করা হলো। তার গ্রেপ্তারের পর ‘ব্ল্যাক লোটাস’-এর নেটওয়ার্কের একটি বড় অংশ ভেঙে পড়ল।

কয়েকদিন পর। অর্ণব অরুণিমার গোপন অফিসে বসে আছে। এখন সে কেবল তার মৃত স্ত্রীর প্রতিশোধের নেশায় নেই, এখন সে সত্য এবং ন্যায়ের জন্য কাজ করছে।

অরুণিমা অর্ণবের দিকে ফিরে বললেন, “তোমার নতুন পরিচয় আর লুকানো নেই, অর্ণব সেন। তুমি এখন আর শুধু লেখক নও, তুমি এখন একজন এজেন্ট। তুমি এখন আমাদের অংশ।”

অর্ণবের চোখে ছিল এক মিশ্র অনুভূতি—পুরোনো জীবনের সমাপ্তি এবং নতুন জীবনের সূচনা। সে তার পকেটে রিমির পোড়া ডায়েরির একটি পাতা পেল, যেখানে লেখা ছিল: “ভয়কে জয় করো।”

অর্ণব মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। এখন তার জীবন আর দশটা মানুষের মতো নয়, এখন তার জীবন একটি ছায়াছবির চিত্রনাট্য, যেখানে প্রতি মুহূর্তে রহস্য আর রোমাঞ্চ অপেক্ষা করছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *