নিশীথ রাতের অতিথি (পর্ব-৪)

সমরেশের বন্দুক গর্জে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই অর্ণব তার সমস্ত শক্তি দিয়ে অরুণিমা ভট্টাচার্যকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিল। গুলিটি পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে পুরোনো জিপের টায়ারে আঘাত করল। অর্ণব এবং অরুণিমা দুজনেই বিদ্যুতের আঁধারে ভাঙা কংক্রিটের আড়ালে আশ্রয় নিলেন।

“তুমি কি পাগল হয়ে গেছো!” অরুণিমা ফিসফিস করে বললেন। “তুমি নিজেকে বিপদের মুখে ফেলে দিলে!”

“আমি শুধু সময় কিনতে চেয়েছিলাম,” অর্ণব হাঁপাতে হাঁপাতে বলল। “আমি তাকে বলেছি ফিল্মটা গুহায় লুকিয়ে রেখে এসেছি। সে এখন বিভ্রান্ত হবে।”

সমরেশ তখন তার দলবলকে ডাকছিল। “এদিকে এসো! সে মিথ্যে বলছে। এখানেই আছে! চারিদিক ঘিরে ফেলো!”

অর্ণব অরুণিমাকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি একা কেন? আপনার সাহায্যকারীরা কোথায়?”

অরুণিমা বললেন, “আমি বুঝতে পারিনি পরিস্থিতি এত গুরুতর। এটা আমার ব্যক্তিগত ফাঁদ ছিল। আমি জানতে চেয়েছিলাম, এই চক্রের প্রধান কে। রিমি আমাকে সতর্ক করেছিল, কিন্তু আমি প্রস্তুত ছিলাম না। এখন আমরা সংখ্যায় কম।”

সমরেশ এবং তার বাকি দুই সঙ্গী ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের টর্চের আলো কংক্রিটের স্ল্যাবগুলিতে ছায়া ফেলছে।

“মি. সেন,” সমরেশের ঠাণ্ডা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “ফিল্মটা দাও, তাহলে হয়তো আমি তোমাদের মরার আগে একটু শান্তিতে কথা বলার সুযোগ দেব।”

অর্ণব জানত, হাতে সময় খুবই কম। সে তার শেষ চালটি চালল।

“ফিল্মের কোডটা আমার জানা আছে, সমরেশ!” অর্ণব চেঁচিয়ে বলল। “ফিল্মটা হাতে পেলেও তোমরা কোড ছাড়া ডেটা দেখতে পাবে না। আর কোড আমি লিখেছি…”

অর্ণব হঠাৎ এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল। তার চোখ গেল পুরোনো জিপের দিকে। রিমি আর তার পুরোনো জিপে করে অনেক অ্যাডভেঞ্চারে গিয়েছিল।

“…আমি কোডটা আমার স্ত্রীর স্মৃতিতে লিখেছি—ওর নাম দিয়ে!”

সমরেশ থমকে গেল। সে অরুণিমাকে ছেড়ে এবার অর্ণবের দিকে তাকাল। কোড ছাড়া ফিল্ম মূল্যহীন, এটা সমরেশ জানত।

“কী সেই কোড?” সমরেশ জিজ্ঞেস করল।

“বলতে পারি, যদি তোমরা আমার একটি শর্ত শোনো,” অর্ণব সাহস সঞ্চয় করে বলল। “তোমরা এখানে যা করেছো, তার জন্য রিমিকে কেন মরতে হলো? তোমরা কেন ওর পিছনে লাগলে?”

অর্ণব জানত, সমরেশের ইগোতে আঘাত লাগলে সে কথা বলবে।

সমরেশ হেসে উঠল। “রিমি? সে একটা সামান্য বাগড়া দিয়েছিল। আমরা ছিলাম ‘দ্য ব্ল্যাক লোটাস’। একটি আন্তর্জাতিক চোরাকারবারী চক্র, যা প্রাচীন পুঁথি ও প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিস পাচার করে। রিমি আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র আবিষ্কার করে ফেলেছিল—চুরির আসল রুট এবং তার মধ্যে জড়িত সরকারের উচ্চপদস্থদের নাম।”

“রিমি জানত যে আমি একজন ডাবল এজেন্ট। সে আমাকে ভুল তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করেছিল,” সমরেশ বলল, “কিন্তু তোমার স্ত্রী ছিল বড্ড স্মার্ট। সে আমার আসল পরিচয় বুঝে গিয়েছিল এবং ফিল্মের মূল অংশটি সরিয়ে রেখেছিল।”

সমরেশ বন্দুকের নল অর্ণবের দিকে তাক করল। “তোমার কথা শেষ। এবার কোডটা বলো, নইলে…”

অর্ণব জানে, এবার আর সময় নেই।

“কোড হলো, রিমিকে কেন মরতে হলো, তার উত্তর! কোডটা হলো… বিশ্বাসঘাতকতা!”

সমরেশ হাসতে শুরু করল। “বিশ্বাসঘাতকতা? কী হাস্যকর! এর চেয়ে ভালো কোড দিতে পারলে না?”

ঠিক এই সুযোগটিই খুঁজছিলেন অরুণিমা ভট্টাচার্য। সমরেশের মনোযোগ অন্যদিকে সরে যাওয়ায় তিনি প্রস্তুত ছিলেন।

অরুণিমা হঠাৎ করে উঠে দাঁড়ালেন এবং হাতের লুকানো ড্যাগার (ছোট ছুরি) ছুঁড়ে মারলেন। সেটা দ্রুত গতিতে সমরেশের হাতের বন্দুকের দিকে গেল।

ড্যাগারটি সমরেশের হাতে আঘাত করল না, কিন্তু তার হাতের গ্রিপ দুর্বল হয়ে গেল। বন্দুক ছিটকে মাটিতে পড়ল।

“এই সুযোগ!” অরুণিমা চিৎকার করলেন।

ঠিক সেই মুহূর্তে, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাইরে থেকে তীব্র সাইরেনের শব্দ ভেসে এল। পুলিশের গাড়ির হেডলাইট পুরো এলাকা আলোকিত করে তুলল।

অর্ণব হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। অরুণিমা তার ফোন থেকে আগেই গোপনে সাহায্যকারী দল এবং পুলিশকে খবর দিয়েছিলেন।

সমরেশ বুঝতে পারল, খেলা শেষ। সে এবং তার বাকি দলবল পালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু চারদিক থেকে পুলিশ দ্রুত এগিয়ে এল এবং তাদের ঘিরে ফেলল।

অর্ণব মাটিতে বসে পড়ল। তার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। সে বাঁচল! কিন্তু এই জয়ের মধ্যে মিশে ছিল তার স্ত্রীর হারানোর গভীর বেদনা।

অরুণিমা এগিয়ে এলেন। “তোমার কৌশল সফল হয়েছে, অর্ণব। তুমি সময়ও কিনেছো আর তাদের স্বীকারোক্তিও আদায় করেছো।”

পরের দিন সকালে, পুলিশ গুহা থেকে মাইক্রোফিল্মটি উদ্ধার করল। কোডটি ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ ছিল না, কিন্তু অর্ণবের চালাকি কাজে এসেছিল। ফিল্মের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেল, সমরেশের দেওয়া তথ্য সঠিক। এই চক্রে দেশের প্রভাবশালী অনেক রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ী জড়িত।

অর্ণব তার মৃত স্ত্রী রিমির ডায়েরিটি হাতে নিল। রিমি চলে যাওয়ার সময় তাকে যে নির্দেশটি দিয়ে গিয়েছিল, আজ সেটা সফল হয়েছে। সে পালিয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্যকে প্রকাশ করার জন্য ফিরে এসেছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *