অর্ণবের শরীর ক্লান্ত, পোশাক ছিন্নভিন্ন। কিন্তু তার চোখে এখন কেবল একটি লক্ষ্য—৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পরিত্যক্ত পুরোনো জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। রাত এখন গভীর। জঙ্গলের পথ ধরে অর্ণব দ্রুত হাঁটছে, তার হাতে রিমির দেওয়া ম্যাপ এবং বুকে লুকিয়ে রাখা মাইক্রোফিল্মের ঠিকানা।
ম্যাপ অনুযায়ী, জঙ্গল শেষ হওয়ার পর একটি পুরোনো রেললাইন আছে, যা সরাসরি শহরের প্রান্তে পৌঁছানো যায়।
প্রায় দুই ঘণ্টা হাঁটার পর, অর্ণব শেষ পর্যন্ত জঙ্গল পেরিয়ে রেললাইনে এসে পৌঁছাল। চারদিকে নিস্তব্ধতা। রেললাইনটি বহু বছর ধরে অব্যবহৃত, তাতে জং ধরেছে। অর্ণব রেললাইন ধরে হাঁটা শুরু করল, যা তার জন্য কিছুটা স্বস্তি এনে দিল, কারণ এই পথে হাঁটা সহজ।
অর্ণব হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল, সমরেশ এখন কী করছে। নিশ্চয়ই সে গুহার চারপাশে তল্লাশি চালাচ্ছে। কিন্তু অর্ণব জানে, ফিল্মটি সুরক্ষিত আছে। এখন তার প্রধান কাজ হলো অরুণিমা ভট্টাচার্যের কাছে পৌঁছানো।
হঠাৎ, রেললাইনের বাঁকের ওপারে একটি ক্ষীণ আলোর ঝলকানি দেখতে পেল অর্ণব। সে দ্রুত একটি ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। আলোটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। কাছে আসতেই অর্ণব দেখতে পেল, এটা একটি ভাঙাচোরা জিপ। আরোহী মাত্র একজন, একজন বয়স্ক লোক, যার মুখে এক রাশ সাদা দাড়ি। লোকটি গাড়ি থামিয়ে রেললাইনের পাশে কিছু একটা খুঁজছে।
লোকটি ছিল স্থানীয় এক কাঠুরে, নাম হরি সিং। অর্ণব দেখল, হরি সিং-এর জিপে কিছু কাঠ ও জ্বালানি রাখা আছে।
অর্ণবের কাছে এটাই ছিল একমাত্র সুযোগ। সে ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে হরি সিং-এর দিকে এগিয়ে গেল।
“হরি সিং,” অর্ণব ফিসফিস করে ডাকল।
হরি সিং চমকে উঠল। “কে? এত রাতে জঙ্গলে! তুমি কে?”
“আমার নাম অর্ণব সেন। শৈলশিখা বাংলোর মালিক,” অর্ণব বলল। “আমার স্ত্রী রিমি আপনার কাছে প্রায়ই আসত। আমার বিপদ হয়েছে, হরি সিং। কিছু লোক আমার পিছু নিয়েছে। আমাকে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছাকাছি পৌঁছে দিতে পারবেন?”
হরি সিং অর্ণবের বিধ্বস্ত চেহারা আর তার চোখে থাকা ভয় দেখে কিছুটা নিশ্চিত হলো। সে রিমিকে চিনত, একজন ভালো মানুষ হিসেবে। “জানি না কী হয়েছে, বাবু। কিন্তু তুমি যখন বলছো বিপদ, তখন নিশ্চয়ই বড় কিছু। ভেতরে এসো, তাড়াতাড়ি।”
অর্ণব দ্রুত জিপের পিছনে চড়ে বসল।
জিপ চলতে শুরু করল। কাঁচা পথ ধরে জিপটি খুব ধীর গতিতে যাচ্ছিল, কারণ রাস্তাটি খুবই খারাপ। অর্ণবের বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। সে বারবার পিছনে তাকাচ্ছে।
প্রায় আধ ঘন্টা চলার পর, অর্ণব পিছনের অন্ধকারে হেডলাইটের আলো দেখতে পেল। আলোটা দ্রুত তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
“হরি সিং! ওটা ওদের গাড়ি। গতি বাড়ান, প্লিজ!” অর্ণব চিৎকার করল।
হরি সিং প্রাণপণে জিপের গতি বাড়ালেন। কিন্তু পুরোনো জিপ বেশি দ্রুত চলতে পারছিল না। পিছনের গাড়ির আলো ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।
“ওরা গুলি করতে পারে!” অর্ণব সতর্ক করল।
সমরেশের দলবল যখন কাছাকাছি চলে এল, তখন জিপের পিছনে বসা অর্ণব দেখল, তাদের একজন হাত বের করে বন্দুক তাক করছে।
হরি সিং দ্রুত স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে জিপটিকে একটি খাদের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। “এই পথে যান! এটা সরাসরি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে পৌঁছায়, যদিও পথটা বিপজ্জনক!”
অর্ণব জানত, এই মুহূর্তে পিছু হটা মানে ধরা পড়া। তারা সংকীর্ণ, পাথর আর খাদে ভরা একটি পথে প্রবেশ করল। পিছনের গাড়ির আলো এখন তাদের আরও কাছে।
হঠাৎ, সমরেশের গাড়ি থেকে একটি গুলি ছুটে এল এবং জিপের পিছনের চাকার কাছাকাছি আঘাত করল। চাকাটি বিকট শব্দে ফেটে গেল।
জিপটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। কোনোমতে হরি সিং গাড়িটিকে ধরে রাখলেন।
“আর চলবে না, বাবু! তোমরা নামো!” হরি সিং চিৎকার করলেন।
অর্ণব এবং হরি সিং দ্রুত লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নামলেন। অর্ণব হরি সিংকে জোর করে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে দিলেন।
“আপনি যান, হরি সিং। ওরা আমার পিছু নিয়েছে, আপনার কিছু হবে না!”
অর্ণব এবার একা দৌড়াতে শুরু করল। সামনেই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিশাল, পুরোনো কাঠামো দেখা যাচ্ছে।
অর্ণব জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রাচীর টপকে ভেতরে প্রবেশ করল। স্থানটি বিশাল, পরিত্যক্ত মেশিনপত্র আর ভাঙা দেয়ালের জঙ্গল। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ছিল অন্ধকারে ঢাকা, কেবল চাঁদনী রাতের অল্প আলোয় কিছু অংশ দেখা যাচ্ছিল।
অর্ণব ম্যাপের নোটটি বের করল: “অরুণিমা, শহর থেকে ৪০ কিমি পূর্বে – পুরোনো জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র।”
সে বিশাল কাঠামোটির মূল ভবনের দিকে এগোতে লাগল। প্রতিটি পদক্ষেপেই তার মনে হচ্ছে যেন তার পিছন থেকে কেউ আসছে।
সে যখন মূল ভবনের সামনে পৌঁছাল, দেখল সেখানে একটি সামরিক ধাঁচের জিপ দাঁড়িয়ে আছে। এবং জিপের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন একজন মহিলা—উচ্চতা মাঝারি, পরণে ট্রাউজার এবং জ্যাকেট, চোখে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ছাপ।
মহিলাটি মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। তিনি অর্ণবকে দেখতে পেলেন।
“অর্ণব সেন, তাইতো?” মহিলাটি মোবাইলটি পকেটে রেখে এগিয়ে এলেন।
“আপনি… আপনি কি অরুণিমা ভট্টাচার্য?” অর্ণব প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল।
মহিলাটি মাথা নেড়ে হাসলেন। “হ্যাঁ। আমি জানতাম রিমি তোমার কাছে কোনো সূত্র রেখে যাবে।”
ঠিক তখনই, পিছনের প্রাচীর টপকে ভেতরে প্রবেশ করল সমরেশ। তার হাতে বন্দুক।
“অরুণিমা ভট্টাচার্য! আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করবেন না। ফিল্মটা আমার চাই!” সমরেশ চিৎকার করল।
অর্ণব দেখল, সমরেশ বন্দুক তাক করেছে সরাসরি অরুণিমাকে লক্ষ্য করে।
অর্ণব নিজেকে রক্ষা করতে প্রস্তুত নয়, কিন্তু রিমির বিশ্বাসকে রক্ষা করতে সে তৈরি। সে দ্রুত অরুণিমার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
“ফিল্মটা আমার কাছে নয়, সমরেশ!” অর্ণব চিৎকার করল, “এটা গুহায় লুকানো আছে!”
সমরেশের বন্দুক গর্জে উঠল।
(চলমান)
