অর্ণব দৌড়ে চলল। ঘন জঙ্গল, পিচ্ছিল কাদা আর ঝোড়ো বৃষ্টির কারণে তার গতি কমে আসছে। পিছনে, সমরেশ এবং তার দলবলের চিৎকার শোনা যাচ্ছিল—তারা সার্চলাইট জ্বালিয়ে তাকে খুঁজছে। অর্ণবের শ্বাস দ্রুত হতে থাকে। সে বুঝতে পারল, বাংলো থেকে বেরোবার সময় সে একটি ভুল করেছে: সে সরাসরি নিচের ঢালের দিকে দৌড়েছে, যা তাদের পক্ষে অনুসরণ করা সহজ।
হঠাৎ তার মনে পড়ল রিমির বলা একটি কথা। শৈলশিখা বাংলোর পিছনে একটি প্রাচীন, পরিত্যক্ত বৌদ্ধ গুহা আছে, যা কেবল স্থানীয় কিছু মানুষ জানে। রিমি মজা করে বলত, “যদি কখনো আত্মগোপন করতে হয়, তো ওই গুহাই সেরা জায়গা।”
অর্ণব দ্রুত দিক পরিবর্তন করে পাথরের খাঁজ এবং ঝোপঝাড়ের দিকে এগোতে লাগল। কিছুদূর যাওয়ার পর, একটি বিশাল পাথরের আড়ালে সে গুহার প্রবেশপথটি খুঁজে পেল—ছোট, স্যাঁতসেঁতে এবং লতাপাতায় ঢাকা। কোনোমতে সে ভেতরে প্রবেশ করল।
গুহার অভ্যন্তরে নিস্তব্ধতা। বাইরের ঝড়ের গর্জন এখানে পৌঁছাচ্ছে না। অর্ণব তার ভেজা শরীর নিয়ে একটি পাথরের ওপর বসে হাফাল। পকেটে হাত দিয়ে দেখল, মাইক্রোফিল্মটি সুরক্ষিত আছে।
কিন্তু শান্ত থাকা গেল না বেশিক্ষণ। তার মনে পড়ল: সমরেশ সহজে হার মানবে না। সে জানে ফিল্মটি অর্ণবের কাছে আছে।
অর্ণব তার মোবাইল ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালাল। গুহাটি বেশ বড়, তার দেয়ালে পুরোনো ফাটল এবং শ্যাওলা। সে দেখল, একটি ভাঙা পাথরের বেদীর ওপর পুরোনো একটি মাটির পাত্র রাখা। পাত্রটি তুলে দেখল, ভেতরে একটি ছোট ব্যাটারি চালিত টর্চলাইট, জলের বোতল এবং একটি ভাঁজ করা ম্যাপ।
এটি রিমির কাজ। রিমি জানত এই বিপদ আসছে এবং আগে থেকেই এখানে তার জন্য কিছু ব্যবস্থা করে রেখেছিল।
ম্যাপটি খুলল অর্ণব। এটা শুধু জঙ্গলের ম্যাপ নয়, বরং এটা ছিল বাংলো থেকে প্রধান সড়ক পর্যন্ত পৌঁছানোর এক গোপন পথ, যা মূলত চোরাশিকারীরা ব্যবহার করত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ম্যাপের একটি বিশেষ স্থানে একটি ছোট করে লেখা নোট: “অরুণিমা, শহর থেকে ৪০ কিমি পূর্বে – পুরোনো জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র।”
তাহলে অরুণিমা ভট্টাচার্যের সহকারী হওয়ার ভান করে সমরেশ মিথ্যা বলেনি যে তিনি তদন্ত করছেন। আসল সত্য হলো, রিমির বিশ্বাস ছিল একমাত্র অরুণিমা ভট্টাচার্যই এই চক্রকে ধরতে পারবেন।
অর্ণব বুঝল, তাকে আর দেরি করা চলবে না। তাকে অরুণিমার কাছে পৌঁছাতে হবে।
ঠিক সেই মুহূর্তে, গুহার প্রবেশপথের কাছে একটি আলো ঝলসে উঠল।
সমরেশের দল গুহার বাইরে এসে পড়েছে।
“ভেতরে কে আছে, বেরোও! নাহলে আমরা ভেতরে গুলি চালাব!” সমরেশের গলা শোনা গেল। তার স্বরে কোনো তাড়াহুড়ো ছিল না, বরং ছিল এক চাপা উত্তেজনা।
অর্ণব দেওয়ালে সেঁটে গেল। সে দেখল, গুহার শেষ প্রান্তে একটি ছোট ফাটল আছে—খুব সম্ভবত এটা একটা সেকেন্ডারি পথ। কিন্তু এখন সেটা ব্যবহার করা অসম্ভব, কারণ গুহার ভেতরের দিকে আসতে হলে সমরেশের দল তাদের মুখোমুখি হবে।
হঠাৎ অর্ণবের মাথায় একটি চিন্তা এলো। রিমি তাকে কী বলেছিল? “সময় নষ্ট করো।”
অর্ণব পকেট থেকে ফিল্মটি বের করে গুহার ভেতরের দিকের একটি পাথরের খাঁজে লুকিয়ে রাখল। তারপর সে টর্চলাইটটি ধরল।
“আমি বেরোচ্ছি!” অর্ণব চিৎকার করল।
যখন সে দরজার কাছে পৌঁছাল, সমরেশ ভেতরে এল। তার হাতে বন্দুক।
“খুব চালাকি দেখাচ্ছ, অর্ণব,” সমরেশ বলল। “ফিল্মটা কোথায়?”
অর্ণব নিঃশ্বাস চেপে ধরল। “আমি ফিল্মটা ধ্বংস করে দিয়েছি।”
সমরেশের চোখ কুঁচকে গেল। “মিথ্যা বলছো! কোথায় ফেলেছ, বলো!”
“সেটা জানার জন্য তোমাকে আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, তাই না?” অর্ণব প্রতি-আক্রমণ করল।
সমরেশ হাসল। একটা শীতল, হিসহিসে হাসি। “আমার মনে হয় না। এই তথ্যটা আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তুমি মরলে, ফিল্মটা আমরা নিশ্চয়ই খুঁজে নেব।”
সমরেশ টর্চলাইট জ্বালিয়ে গুহার ভেতরটা দেখতে শুরু করল। তার দলবলও গুহার দিকে মনোযোগ দিল। অর্ণব তখন সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।
হঠাৎ অর্ণব তার কোমর থেকে একটি বড় পাথর তুলে গুহার সিলিংয়ের দুর্বল অংশ লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারল। পাথরটি এমন জায়গায় আঘাত করল, যেখানে ছাদের একটি বড় অংশ আলগা হয়ে ছিল। বিকট শব্দে কিছু পাথর ধসে পড়ল, যা গুহার প্রবেশপথকে আংশিকভাবে বন্ধ করে দিল এবং ধোঁয়ায় ভরে গেল।
ধসে পড়ার শব্দে এবং ধূলোয় সমরেশ ও তার দলবল দিশেহারা হয়ে গেল। অর্ণব দ্রুত গুহার ভেতরের দিকের ফাটল দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে গেল।
ফাটলটি ছিল সংকীর্ণ এবং অত্যন্ত দুর্গম। অর্ণবের সারা শরীরে কাঁটা আর পাথরের আঘাত লাগল। অনেক কষ্ট করে সে যখন বাইরে বেরোল, তখন সে নিজেকে বাংলোর প্রায় এক কিলোমিটার দূরে জঙ্গলের অন্য প্রান্তে খুঁজে পেল।
কিন্তু সময় নেই। সে ম্যাপটি বের করল। তাকে যেতে হবে পুরোনো জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দিকে।
সে দৌড়াতে শুরু করল, এবার তার উদ্দেশ্য পরিষ্কার: কোনো অবস্থাতেই ধরা দেওয়া নয়, অরুণিমা ভট্টাচার্যের কাছে পৌঁছানো। সে বুঝতে পারছিল, রিমির মৃত্যুর প্রতিশোধ এবং হাজার হাজার মানুষের জীবন, যারা ঐ ফিল্মের তথ্যের কারণে বিপদে পড়তে পারে, তা কেবল তার সাহস ও দ্রুততার ওপর নির্ভর করছে।
অর্ণব ঘন জঙ্গলের গভীরে হারিয়ে গেল… তার পিছনে লেগে রইল এক ভয়ংকর থ্রিলারের ছায়া।
