নিশীথ রাতের অতিথি (পর্ব-১)

শহর থেকে বহু দূরে, মেঘে ঢাকা নৈসর্গিক পাহাড়ের ঢালে জীর্ণ অথচ অভিজাত ‘শৈলশিখা’ বাংলোটি দাঁড়িয়ে। এর মালিক, তরুণ লেখক অর্ণব সেন, এক বছর আগে তার স্ত্রী রিমির রহস্যময় মৃত্যুর পর থেকেই এখানে একাকী বাস করছেন। পুলিশ এটিকে আত্মহত্যা বললেও, অর্ণবের মন মানতে পারেনি। রিমির হাতের একটি ছোট, পোড়া ডায়েরি অর্ণবকে অন্য এক ইশারা দিয়েছিল—’পালাও। সে আসছে।’

অর্ণব জানত না ‘সে’ কে।

আজ এক ঝোড়ো রাতে বাংলোর দরজায় কড়া নাড়ল এক আগন্তুক। মাঝবয়সী, তীক্ষ্ণ চোখের সেই মানুষটি নিজেকে বলল অরুণিমা ভট্টাচার্যের সহকারী। অরুণিমা ভট্টাচার্য হলেন শহরের সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং কুখ্যাত অপরাধ তদন্তকারী।

“মি. সেন,” আগন্তুক, যার নাম সমরেশ, বলল। তার কণ্ঠস্বর ছিল অদ্ভুত রকম শান্ত, “ম্যাডাম বিশ্বাস করেন আপনার স্ত্রী খুন হয়েছেন। এবং এই খুন কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। এর সঙ্গে একটি আন্তর্জাতিক চক্র জড়িত, যারা প্রাচীন পুঁথি চুরি করে।”

অর্ণব স্তব্ধ হয়ে গেল। “পুঁথি? রিমি…”

“আপনার স্ত্রী একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ ছিলেন। আপনি জানতেন না, তিনি একটি অত্যন্ত গোপন অভিযানে কাজ করছিলেন। আপনার বাড়িতে একটি জিনিস আছে, যা তারা চায়,” সমরেশ বলল।

অর্ণব দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, কিন্তু সমরেশের চোখে সে এমন এক দৃঢ়তা দেখল যা তাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করল। অর্ণব সমরেশকে বাংলোর ভেতরে নিয়ে গেল।

বাংলোর প্রতিটি কোণে রিমি তার স্মৃতি রেখে গেছে। কিন্তু অর্ণবের চোখ গেল বসার ঘরের টেবিলের দিকে। সেখানে একটি পুরোনো পাথরের মূর্তি রাখা ছিল—রিমি উপহার দিয়েছিল।

“এই মূর্তিটা,” সমরেশ নিচু স্বরে বলল, “আসলে একটি ধাঁধার চাবি। এর ভেতরে একটি মাইক্রোফিল্ম লুকানো আছে। তাতে যে তথ্য আছে, তা প্রকাশ পেলে অনেক ক্ষমতাধর মানুষের মুখোশ খুলে যাবে।”

অর্ণব দ্রুত মূর্তিটি ভাঙতে শুরু করল। ভেতরে পাওয়া গেল একটি অতি ক্ষুদ্র, ভাঁজ করা মাইক্রোফিল্ম। কিন্তু ঠিক তখনই, বাংলোর বাইরে একটি গাড়ির শব্দ শোনা গেল।

“তাড়াতাড়ি, তারা এসে গেছে,” সমরেশ ফিসফিস করে বলল।

অর্ণব ফিল্মটি পকেটে পুরল। “অরুণিমা ভট্টাচার্যের কাছে যাব কী করে?”

“আপনি যাবেন না। আমাকে যেতে হবে। আপনি থাকুন এবং সময় নষ্ট করুন। আমি পথ পরিষ্কার করছি,” সমরেশ দরজা খুলে ঝড়ের মধ্যে বেরিয়ে গেল।

অর্ণব জানালার পর্দা সরিয়ে দেখল। বাইরে বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে গুলির শব্দ। সমরেশকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়েছে। কিন্তু সমরেশ কৌশলে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই, তিন জন মুখোশধারী লোক দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকল। তাদের হাতে ছিল অত্যাধুনিক অস্ত্র।

“ফিল্মটা দাও,” একজনের কর্কশ কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

অর্ণব জানত এখন পালানোর কোনো উপায় নেই। সে ফিল্মটি বের করে টেবিলের ওপর রাখল।

“এত সহজে দিয়ে দিচ্ছ?” দ্বিতীয়জন হাসল।

অর্ণব বলল, “তোমরা কাকে খুঁজছো? কে তোমাদের আসল বস? অরুণিমা ভট্টাচার্য?”

মুুখোশধারী লোকগুলো একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের হাসির শব্দ হঠাৎ থেমে গেল।

তৃতীয়জন মাস্ক খুলল। তার মুখ দেখে অর্ণবের পায়ের নিচে মাটি সরে গেল। এ তো সেই লোক, সমরেশ!

“আমি অরুণিমা ভট্টাচার্যের সহকারী নই, অর্ণব,” সমরেশ/আগন্তুক বলল। “আমি সেই ‘সে’, যার কথা রিমি লিখেছিল। রিমি ফিল্মটা আমার হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই মারা গিয়েছিল। এবং সে জানত, একমাত্র তুমিই ফিল্মটা খুঁজে পাবে।”

অর্ণবের মাথায় বিদ্যুতের ঝলক খেলে গেল। সমরেশ ছিল আসলে অপরাধী চক্রের নেতা, যে অর্ণবকে বিশ্বাস করিয়ে ফিল্মটি খুঁজে বের করাতে চেয়েছিল।

অর্ণবের সামনে এখন মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্তু রিমি তাকে শেষ যে সূত্র দিয়েছিল, সেটা ছিল ‘পালাও’।

“তুমি ভাবছো আমি ফিল্মটা দেব?” অর্ণব একটি চতুর হাসি হাসল।

সে হঠাৎ করে টেবিলের ল্যাম্প তুলে মেঝেতে ছুঁড়ে মারল। কাঁচের টুকরোগুলো ছড়িয়ে পড়তেই অর্ণব দ্রুত তার হাতের পোড়া ডায়েরিটি মেঝেতে ফেলে তার ওপর পা দিয়ে ঘষতে লাগল।

এক মুহূর্তের জন্য সমরেশ দ্বিধা করল। সে চেয়েছিল অর্ণবকে শান্ত রেখে ফিল্মটা নিতে। কিন্তু এখন সময় নেই। সে যখন অর্ণবের দিকে গুলি করার জন্য বন্দুক তুলল, ঠিক তখনই, বিকট শব্দে বাংলোর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। অর্ণবের কাছে এটাই ছিল সুযোগ।

অর্ণব মুহূর্তের মধ্যে তার হাতে থাকা ভারি, মজবুত পাথরের মূর্তিটির ভাঙা অংশ নিয়ে সমরেশের দিকে ছুঁড়ে মারল। আঘাত লেগে সমরেশের হাত থেকে বন্দুক ছিটকে গেল।

এরপর শুরু হলো শ্বাসরুদ্ধকর ধস্তাধস্তি। অন্ধকার আর ঝড়ের শব্দের মধ্যে অর্ণব কোনোমতে বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বাইরে ঝোড়ো বাতাস আর কাদা তাকে আরও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলল। সে দৌড়াতে শুরু করল, জঙ্গলের ভেতরের অজানা পথের দিকে।

পিছন থেকে সমরেশের চিৎকার শোনা গেল, “তুমি পালাতে পারবে না, অর্ণব! ওই তথ্য চিরকাল অন্ধকারের নিচেই থাকবে!”

অর্ণব দৌড়াচ্ছে… একদিকে তার মৃত স্ত্রীর শেষ স্মৃতি, অন্যদিকে ফিল্মে লুকিয়ে থাকা ভয়ংকর সত্য। তার জানা নেই, সে কোথায় যাচ্ছে, কিন্তু সে জানে—যদি সে বাঁচতে পারে, তাহলেই কেবল রিমির মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়া সম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *