শহরে অপুর দিনগুলো ছিল কঠোর পরিশ্রম আর একাগ্রতার এক দীর্ঘ অধ্যায়। তার মায়ের ত্যাগের কথা মনে রেখে সে কোনোদিন বিলাসিতা বা আলস্যকে প্রশ্রয় দেয়নি। তার একমাত্র মনোযোগ ছিল পড়াশোনা আর কাজ।
দীর্ঘ সাত বছর পর, অপু তার শিক্ষাজীবন শেষ করল এবং তার মেধার জোরে শহরের একটি নামকরা বহুজাতিক কোম্পানিতে উচ্চ বেতনে চাকরি পেল। তার এই সাফল্য ছিল তার মায়ের ত্যাগের ফসল।
প্রথম মাসের বেতন হাতে পাওয়ার দিন। অপুর মনে আনন্দের চেয়েও বেশি ছিল এক অদ্ভুত শূন্যতা। সে জানে, এই বেতন তার নয়, এই বেতন তার মায়ের পরিশ্রমের প্রতিদান। অপু তার সমস্ত টাকা নিয়ে একটি বড় ব্যাগ ভরে নিল এবং দ্রুত গ্রামের পথে রওনা হলো।
গ্রামে ফিরে সে দেখল, সর্বাণী আজও সেই পুরোনো কুটিরেই থাকেন, আর এখনও রাতের বেলা সেলাই করেন। তার দৃষ্টি এখন দুর্বল, কিন্তু তার মুখে লেগে আছে এক চাপা হাসি।
অপু দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। সর্বাণী ছেলেকে দেখে চমকে উঠলেন, যেন বিশ্বাস করতে পারলেন না।
“অপু! তুই… তুই ফিরে এসেছিস!” সর্বাণীর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।
অপু মাকে জড়িয়ে ধরল। এই আলিঙ্গন ছিল বছরের পর বছর ধরে জমা থাকা আবেগ আর ভালোবাসার বিস্ফোরণ।
“মা, আর নয়। তোমার কষ্ট শেষ,” অপু তার মাকে মেঝে থেকে তুলে ধরল।
অপু তার মাকে নিয়ে শহরে চলে এল। একটি আধুনিক, সুন্দর ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটটি ছিল আলো ঝলমলে এবং আরামদায়ক। সর্বাণীর জন্য ফ্ল্যাটের বারান্দায় অপু তার পছন্দের গন্ধরাজ ও গোলাপ গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করল।
প্রথম কিছুদিন সর্বাণী এই বিলাসবহুল জীবনে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। তার সব সময় মনে হতো, তিনি গ্রামের জীবন ছেড়ে এসে ছেলেকে শুধু খরচ বাড়াচ্ছেন। তিনি প্রায়ই অপুকে বলতেন, “বাবা, আমি কেন এত আরামে থাকব? আমি ফিরে যাই। তুই বিয়ে কর, ঘর সংসার কর।”
অপু হাসত। সে জানত, তার মায়ের এই অস্থিরতা তার অতিরিক্ত ভালোবাসার প্রকাশ।
একদিন, সর্বাণী যখন বারান্দায় বসে ফুল দেখছিলেন, অপু তার পাশে এসে বসল।
“মা,” অপু বলল, “তোমার কাছে আমি একটি জিনিস জানতে চাই। তুমি আমাকে ভালোবাসতে, তাই তুমি তোমার রুপার হার বিক্রি করেছিলে। আমি তোমাকে ভালোবাসি, তাই তোমার সবথেকে প্রিয় মানুষটির সেবা করতে চাই। তুমি কেন যেতে চাইছো?”
“তুই কেন বুঝিস না, বাবা? তুই বিয়ে কর। তোর নিজের সংসার দরকার,” সর্বাণী বললেন।
“তুমিই আমার ঘর, আর তুমিই আমার সংসার, মা। তুমি এত কষ্ট করে আমাকে বড় করেছো, আর আজ তুমি যখন একটু আরাম করবে, তখন তুমি চলে যেতে চাইছো? তোমার ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারব না। তুমি এখানে না থাকলে আমার এই সাফল্য মূল্যহীন।”
অপু তার পকেট থেকে একটি ছোট মখমলের বাক্স বের করল। বাক্সটি খুলে সর্বাণীর হাতে তুলে দিল। ভেতরে জ্বলজ্বল করছিল একটি সুন্দর হীরের আংটি।
“মা,” অপু বলল, “তোমার বাবার দেওয়া রুপার হারটি ছিল তোমার ত্যাগের প্রতীক। আর এই আংটি হলো আমার ভালোবাসার প্রতীক। এটা রুপার হার নয়, এটা হলো তোমার ত্যাগের প্রতিদান। আমি চাই, তুমি এটা পরো।”
সর্বাণী অপুর দিকে তাকালেন। তার চোখে জল। হীরের আংটির মূল্য তার কাছে তুচ্ছ ছিল। তার কাছে মূল্যবান ছিল তার ছেলের অর্জন এবং সেই অর্জনকে মায়ের পায়ে নিবেদন করার মানসিকতা।
সর্বাণী আবেগে অপুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। এবার তার কান্না ছিল চরম তৃপ্তির। তিনি বুঝতে পারলেন, তার জীবনের সমস্ত সংগ্রাম সার্থক হয়েছে। তিনি ছেলেকে শুধু বড় করেননি, তিনি তাকে একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন, যে তার শিকড় আর মূল্যবোধকে ভোলেনি।
সেই দিন থেকে সর্বাণী আর কোনো অভিযোগ করেননি। তিনি তার নতুন জীবনের আনন্দ উপভোগ করতে শুরু করলেন—তার ছেলের সাফল্যের আলোয়। মা-ছেলের ভালোবাসার এই বন্ধন ছিল পৃথিবীর সবথেকে পবিত্র এবং নিবিড় বন্ধন।
