ছায়া সুনিবিড় কুটিরে ভালোবাসা – ৪

অপুর বয়স তখন সতেরো। সে গ্রামের হাই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে। তার পরীক্ষার ফল ছিল গ্রামের মধ্যে সেরা। অপুর নাম এখন সকলের মুখে মুখে—গরিব ঘরের ছেলে, কিন্তু মেধাবী।

অপুর সামনে এখন এক নতুন দিগন্ত। তার একমাত্র ইচ্ছা—শহরের সেরা কলেজে বিজ্ঞান নিয়ে পড়া। কিন্তু এই উচ্চাকাঙ্ক্ষার পথে একমাত্র বাধা ছিল তাদের চিরন্তন দারিদ্র্য। শহরের হোস্টেলের খরচ, কলেজের বেতন—সব মিলিয়ে তা সর্বাণীর সামর্থ্যের বাইরে।

প্রতি রাতে অপু আর সর্বাণী আলোচনা করতেন।

“মা, আমি শুধু পাশ করেই একটা কাজ খুঁজতে শুরু করব। আমাকে শহরে যেতে হবে না,” অপু তার মায়ের কষ্ট কমাতে চাইল।

সর্বাণী সেলাই করতে করতে চোখ না তুলেই বললেন, “না, অপু। তুই কাজ করবি না। তোর বাবার স্বপ্ন ছিল তুই একদিন বড় সাহেব হবি। আমার স্বপ্নও তাই। তোর জন্য আমি সব করব।”

“কিন্তু মা, এত টাকা কোথায় পাবে?” অপু প্রশ্ন করল।

সর্বাণী হেসে বললেন, “চিন্তা করিস না। মা থাকতে তোর পড়াশোনা থামবে না।”

একদিন দুপুরে সর্বাণী অপুকে কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তিনি গেলেন গ্রামের এক পুরোনো স্বর্ণকারের কাছে। সর্বাণীর কাছে ছিল তার বাবার দেওয়া একমাত্র স্মৃতি—একটি পুরোনো রুপার হার। স্বামীর মৃত্যুর পর, যত অভাবই আসুক, সর্বাণী এই হারটি কখনও বিক্রি করেননি। এই হারটি ছিল তার কাছে বাবার ভালোবাসা আর পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রতীক।

নীরবে সর্বাণী হারটি স্বর্ণকারের হাতে তুলে দিলেন।

“কাকিমা, এই হার তো আপনি কোনোদিন হাতছাড়া করেননি। বিক্রি করছেন কেন?” স্বর্ণকার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

সর্বাণী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “আমার ছেলে শহরে পড়তে যাবে। তার ভর্তির জন্য টাকার দরকার।”

স্বর্ণকার হারটি নিলেন, কিন্তু সর্বাণীর চোখে তিনি যে পরিমাণ কষ্ট আর ত্যাগ দেখলেন, তা তিনি কখনও ভোলেননি। হার বিক্রির পর হাতে আসা সামান্য টাকা সর্বাণীর কাছে ছিল বিশাল পুঁজি।

বাড়িতে ফিরে সর্বাণী অপুকে বললেন না, তিনি কী করেছেন। তিনি কেবল টাকাগুলো অপুর হাতে তুলে দিলেন।

অপু যখন হার বিক্রির কথা জানতে পারল, তখন সে কেঁদে ফেলল। সে দৌড়ে গিয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরল।

“মা! তুমি এটা কী করেছো? এটা তোমার বাবার স্মৃতি ছিল! এই টাকার জন্য আমি শহরে যাব না!”

অপুর চোখ দিয়ে জল পড়ছিল। তার মনে হলো, তার সাফল্যের জন্য সে তার মায়ের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি কেড়ে নিয়েছে।

সর্বাণী এবার কঠিন হলেন। তার চোখে জল থাকলেও, মুখে ছিল দৃঢ়তা। তিনি অপুর হাত ধরে ঝাঁকালেন।

“চুপ কর! আমি তোর ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে দেব না। তুই যদি পড়াশোনা না করিস, তবে আমার এত কষ্টের কোনো মূল্য থাকবে না। মনে রাখিস, আমার ভালোবাসা তোর সফলতার মধ্যেই বেঁচে থাকবে।”

সর্বাণী অপুকে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে বললেন, “যা, আর আমাকে আর কোনো কথা বলিস না। তুই শহরে যা। আর মাথা উঁচু করে ফিরে আসিস। এটাই তোর মায়ের একমাত্র পাওনা।”

মায়ের আদেশ অমান্য করার সাহস অপুর ছিল না। সে তার মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। সে জানত, এই মুহূর্তে মায়ের কাছ থেকে দূরে যাওয়া মানে তাঁর আত্মত্যাগকে সম্মান জানানো।

চোখের জল আর বুকে একরাশ প্রতিজ্ঞা নিয়ে অপু শহরের দিকে রওনা হলো। শহরের হোস্টেলের পথে যেতে যেতে অপু কেবলই তার মাকে দেওয়া কথাটি মনে মনে আওড়াল: “আমি এমনভাবে ফিরে আসব, যাতে মা আর কখনও কষ্ট না পায়।” সেই হার বিক্রির টাকা অপুর কাছে শুধু অর্থ ছিল না, সেটা ছিল তার মায়ের ত্যাগের প্রতীক, তার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *