অপুর বয়স তখন দশ বছর। সে এখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। সর্বাণীর মনে একটাই বাসনা—অপুর জন্য একটি নতুন জামা কিনবেন। গত কয়েক বছরে অপু সবসময় পুরোনো জামা পরেই স্কুলে গেছে। সর্বাণী তাই লুকিয়ে লুকিয়ে টাকা জমানো শুরু করলেন। দিনের বেলায় কাজের পর রাতে যখন সবাই ঘুমাত, তখন তিনি মোমবাতির ক্ষীণ আলোয় সেলাইয়ের কাজ করতেন। সেলাইয়ের কাজ থেকে আসা সামান্য রোজগার তিনি একটি মাটির ভাঁড়ে জমাতেন।
প্রায় ছ’মাস ধরে তিল তিল করে জমানো টাকায় অবশেষে অপুর জন্য একটা নতুন জামা কেনার মতো টাকা হলো। সর্বাণীর মনে ছিল অপার আনন্দ। তিনি মনে মনে ঠিক করলেন, অপু যখন স্কুলে যাবে, তখন তিনি নিজে শহরে গিয়ে সবচেয়ে সুন্দর জামাটা কিনে আনবেন।
“অপু, এবার পুজোতে তুই নতুন জামা পাবি রে সোনা,” সর্বাণী হাসিমুখে ছেলেকে বললেন।
অপু মায়ের কথা শুনে আনন্দে আত্মহারা। “সত্যি মা? তাহলে আমি নতুন জামা পরে স্কুলে যাবো, আর সবাই দেখবে!”
তাদের এই আনন্দ ছিল ক্ষণস্থায়ী। নিয়তি তাদের জন্য অন্য কিছু লিখে রেখেছিল।
একদিন সন্ধ্যায়। আকাশ কালো করে এলো, শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি। বাতাসের তীব্রতায় কুটিরের কাঁচা চালের টিনগুলো কাঁপতে শুরু করল। সর্বাণী দ্রুত অপুকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘরের এক কোণে আশ্রয় নিলেন।
ভয়াবহ শব্দ করে, এক মুহূর্তে ঝড়ে কুটিরের চালের একটি বড় অংশ উড়ে গেল। আকাশ ভেঙে যেন জল নামতে শুরু করল ঘরের ভেতরে। তাদের বিছানাপত্র, বইখাতা সব ভিজে গেল।
ঝড় থামার পর মা-ছেলে বাইরে বেরোল। তাদের একমাত্র আশ্রয় আজ উন্মুক্ত আকাশের নীচে। চারদিকে শুধু ধ্বংস আর জল।
“মা, এখন কী হবে?” অপু কেঁদে ফেলল। তার চোখ ছিল ভয়ের সঙ্গে অসহায়ত্বে পূর্ণ।
সর্বাণী ভেজা শাড়ি আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন। “কাঁদিস না, বাবা। আমরা দু’জন তো একসঙ্গে আছি। চল, চালটা সরানোর চেষ্টা করি।”
পরের দিন সকাল। আকাশ পরিষ্কার। কিন্তু কুটিরের অবস্থা শোচনীয়। সর্বাণীর কাছে চাল সারানোর কোনো টাকা নেই। তিনি যে টাকা অপুর জামা কেনার জন্য জমিয়েছিলেন, সেটাই এখন একমাত্র ভরসা।
সর্বাণী অপুর দিকে তাকালেন। অপু তখনও চালের দিকে তাকিয়ে ছিল, তার মুখে কোনো কথা নেই।
সর্বাণী আলতো করে অপুর মাথায় হাত রাখলেন। “অপু, তোর নতুন জামা হবে না রে সোনা। আমাকে ওই টাকা দিয়ে চাল সারাতে হবে।”
অপু কোনো দুঃখ প্রকাশ করল না। সে যেন মুহূর্তের মধ্যে বড় হয়ে গেল। সে দৌড়ে গিয়ে মাটির ভাঁড়টা নিয়ে এল। ভাঁড়টা সর্বাণীর হাতে তুলে দিল।
“তুমি কেঁদো না, মা। নতুন জামা না হলে কী হবে? তুমি আর আমি তো একসঙ্গেই আছি। এটাই আসল জামা,” অপু বলল। তার চোখে কোনো অভিযোগ ছিল না, ছিল শুধু মায়ের প্রতি অগাধ ভালোবাসা।
অপু তার হাত দিয়ে মায়ের হাত ধরল। “তুমি চাল সারাও। আমি বন্ধুদের পুরোনো জামা পরে নেব। আমার কাছে তোমার চেয়ে দামি কিছু নেই।”
সর্বাণী ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তার চোখ দিয়ে অনর্গল জল পড়ছিল। এই জল দারিদ্র্যের কারণে নয়, এই জল ছিল গর্ব আর অপার ভালোবাসার। তিনি বুঝতে পারলেন, তার এই কষ্টের জীবন হয়তো অপু-র কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে, কিন্তু বিনিময়ে দিয়েছে এক অটুট বন্ধন এবং আত্মত্যাগের এক মহান শিক্ষা। এই ভালোবাসা তাদের জীবনকে সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী বাঁধনে বেঁধে ফেলেছিল।
