অপুর যখন আট বছর বয়স, তখন একদিন স্কুল থেকে ফিরে সে এক ভয়াবহ দৃশ্য দেখল। তার মা, সর্বাণী, উঠোনে কাজ করতে করতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। অপু ভয় পেয়ে গেল। এই পৃথিবীতে তার মা ছাড়া আর কেউ নেই।
অপুর ছোট মন বুঝতে পারল, এই মুহূর্তে কান্নাকাটি করা চলবে না। তাকেই সব সামলাতে হবে।
অপু দ্রুত কুয়ো থেকে জল আনল, সর্বাণীর মুখে-চোখে জলের ঝাপটা দিল। কিছুক্ষণ পর সর্বাণীর জ্ঞান ফিরল। তার সারা শরীর কাঁপছে, কপালে হাত দিয়ে অপু বুঝতে পারল—জ্বর এসেছে।
“মা, তোমার অনেক জ্বর,” অপু বলল। তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, কিন্তু তার চোখে ছিল দায়িত্বের দৃঢ়তা।
সর্বাণী দুর্বলভাবে হাসলেন। “কিছু না, বাবা। কালকের কাজের ধকল। তুই শুধু একটু শুয়ে থাক।”
অপু জানে, শুধু শুয়ে থাকলে চলবে না। তার মা যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তবে তাদের ঘরে উনুন জ্বলবে না।
পরের দিন ভোরবেলা। সর্বাণী জ্বরের ঘোরে কাতরাচ্ছেন। অপু স্কুল যাওয়ার জন্য প্রস্তুত না হয়েই তার টিফিনের জন্য রাখা দুটো মুড়ি ও সামান্য চিড়ে পলিথিনে ভরে নিল।
অপু সেই পথ ধরল, যে পথে তার মা প্রতিদিন যেতেন—পাশের গ্রামের রমেনবাবুর বাড়ি।
অপু দরজা ঠেলে ভেতরে গেল। রমা কাকিমা তখন ঘর পরিষ্কার করছিলেন।
“কী রে খোকা? তুই এত সকালে? তোর মা কই?” রমা কাকিমা তাচ্ছিল্যের সুরে জানতে চাইলেন।
অপু মাথা নিচু করে বলল, “কাকিমা, মায়ের খুব জ্বর। তাই মা আজ কাজে আসতে পারবেন না। আপনারা কি মাকে একটু দেখতে যাবেন?”
রমা কাকিমা এবার একটু নরম হলেন। তিনি জানতেন, সর্বাণী সামান্য জ্বর নিয়ে কাজে ফাঁকি দেওয়ার মেয়ে নন।
অপু তার টিফিনের মুড়ি আর চিড়ে রমা কাকিমার হাতে তুলে দিল। “কাকিমা, এইগুলো দিয়ে মায়ের জন্য একটু গরম দুধ করে দেবেন? মায়ের ওষুধ কেনার টাকা নেই।”
রমা কাকিমা অপুর চোখে তাকালেন। সেই চোখে তিনি দেখলেন এক অভাবী ছেলের অসহায়তা নয়, বরং দেখলেন এক সন্তানের নিঃশর্ত ভালোবাসা এবং দায়িত্ববোধ। এইটুকু বয়সে সে তার মায়ের জন্য ভিক্ষা করছে না, বরং তার নিজের খাবারটুকুও মায়ের চিকিৎসার জন্য দিতে প্রস্তুত।
“তোর মা তোকে এমন শিক্ষা দিয়েছে, খোকা! তুই সত্যি সোনার টুকরো,” রমা কাকিমার গলা ভিজে এল। তিনি অপুকে জোর করে নিজের হাতে কিছু রুটি আর গুড় খাইয়ে দিলেন, আর সঙ্গে কিছু টাকা দিলেন সর্বাণীর জন্য ওষুধ কেনার জন্য।
অপু সেই টাকা নিয়ে দ্রুত গ্রামে ফিরে গেল। সে মুদির দোকান থেকে মায়ের জন্য প্যারাসিটামল আর একটি ভেষজ মলম কিনে আনল।
সারাদিন অপু তার মায়ের সেবা করল। সে সর্বাণীর পাশে বসল, মাথায় ঠান্ডা জলপট্টি দিল, আর মায়ের পায়ে আস্তে আস্তে মলম মালিশ করতে লাগল। সর্বাণী আধোঘুমে অপুর সেবা অনুভব করছিলেন।
“বাবা,” সর্বাণী ফিসফিস করে বললেন, “তুই আজ স্কুলে যাসনি? তোর পড়াশোনা নষ্ট হচ্ছে।”
অপু মায়ের কপালে চুমু খেল। “মা, আমি কাল সব বন্ধুদের কাছ থেকে সব পড়া বুঝে নেব। কিন্তু পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে জরুরি পড়া হলো—তোমাকে ভালো রাখা। তুমি সুস্থ না থাকলে আমার কোনো পড়াই সম্পূর্ণ হবে না।”
সর্বাণী তার ছেলেকে বুকে টেনে নিলেন। সেদিন তিনি বুঝতে পারলেন, দারিদ্র্য হয়তো তার জীবন থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে, কিন্তু তার ছেলের মধ্যে যে দায়িত্ববোধ আর গভীর ভালোবাসা তৈরি করেছে, তা পৃথিবীর কোনো ধন-সম্পদ দিয়ে কেনা সম্ভব নয়। অপু শুধু তার ছেলে নয়, সে ছিল তার জীবনের রক্ষাকর্তা।
