ছায়া সুনিবিড় কুটিরে ভালোবাসা – ১

শীতের সকাল। কুটিরের ভাঙা জানালা দিয়ে ফিনফিনে ঠান্ডা বাতাস আসে। সর্বাণী (৩০) কাঁপা হাতে উনুনে সামান্য শুকনো কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করছেন। এই কুটিরটিই তার পৃথিবী, এবং তার এই পৃথিবীর একমাত্র আলো হলো তার সাত বছর বয়সী ছেলে অপু

অপুর বাবা মারা গেছেন অপুর জন্মের কিছুদিন পর। সেদিনের পর থেকেই সর্বাণীর জীবন কেবলই সংগ্রাম। গ্রামের মানুষজনের করুণা এবং কিছু কঠিন কথাকে সঙ্গী করে সর্বাণী তার জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। সমাজ তাঁকে ‘একলা মেয়েমানুষ’ হিসেবে দেখত, কিন্তু সর্বাণী জানতেন, তিনি একা নন। তাঁর হৃদয়ে অপুর জন্য যে ভালোবাসা, তা ছিল পৃথিবীর সমস্ত শক্তির চেয়েও বেশি।

সকাল হলেই সর্বাণী বেরিয়ে পড়তেন কাজে। তার হাতে কাঁথা-সেলাই আর পিঠে সংসারের ভার।

“মা, তুমি আজ তাড়াতাড়ি ফিরবে তো?” অপু রোজ স্কুল যাওয়ার আগে এই একই প্রশ্ন করত।

সর্বাণী হাসতেন। তার হাসি ছিল শ্রান্ত, কিন্তু আন্তরিক। “হ্যাঁ রে সোনা, তাড়াতাড়ি ফিরব। তোর জন্য পুঁটি মাছ আর দুটো পেঁপে নিয়ে আসব।”

অপু জানে, মা ফিরলে শুধু খাবার নয়, তার সঙ্গে আসবে এক বুক নির্ভরতা।

সর্বাণীর দিনের শুরু হতো পাশের গ্রামের ধনী কৃষক রমেনবাবুর বাড়ি থেকে। সেখানে বাসন মাজা, ঘর মোছা থেকে শুরু করে ধান ঝাড়া পর্যন্ত সমস্ত কাজ করতে হতো। কাজ শেষে তার হাতে আসত সামান্য পারিশ্রমিক, যা দিয়ে অপু আর নিজের একবেলার আহার জোটানো যেত।

একদিন দুপুরে সর্বাণী রমেনবাবুর ধান ঝাড়ার কাজ করছিলেন। রোদ ছিল তীব্র। কাজ করতে করতে সর্বাণীর মাথা ঘুরে উঠল। শরীর আর চলছিল না।

রমেনবাবুর স্ত্রী রমা ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন, “সারাদিন তো শুয়েই থাকিস, আর একটু কাজ করলেই শরীর খারাপ! কাজ করতে না পারলে চলে যা, সর্বাণী। এখানে সহানুভূতি দেখানোর জায়গা নেই।”

সর্বাণী কোনো প্রতিবাদ করলেন না। প্রতিবাদ করার ক্ষমতা তার ছিল না। তিনি কেবল মাথা নিচু করে নিজের আঁচল দিয়ে কপাল মুছে নিলেন। তিনি জানেন, তাঁর প্রতিবাদ করার অধিকার নেই। তাঁর একমাত্র অধিকার হলো—অপুর জন্য বেঁচে থাকা এবং কাজ করে যাওয়া।

সেইদিন রাতে ঘরে ফিরে সর্বাণী দেখলেন, অপু তাঁর জন্য জল গরম করে রেখেছে।

“মা, তোমার শরীর খারাপ? তুমি আজ এত দেরি করলে কেন?” অপু উদ্বেগ নিয়ে জিজ্ঞেস করল।

অপুর হাতে গরম জলের স্পর্শে সর্বাণীর মনে হলো, দিনের সব কষ্ট যেন এক মুহূর্তে দূর হয়ে গেল। এই সামান্য ভালোবাসা তার জীবন যুদ্ধের একমাত্র রসদ।

অপু ছিল সর্বাণীর জীবনের সবথেকে বড় অবলম্বন। সে শুধু ভালো ছাত্র ছিল না, সে ছিল তার মায়ের সবচেয়ে ভালো বন্ধু।

একদিন রাতে, বাইরে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। কুটিরের চাল দিয়ে জল পড়ছিল। সর্বাণী ভেজা কাঠ দিয়ে উনুন জ্বালাতে পারছিলেন না। অপু তখন তার পড়ার টেবিলের ওপর থেকে কেরোসিনের লম্ফটা নিয়ে এল।

“মা, উনুন জ্বলছে না। চলো, আমরা গল্প করি,” অপু বলল।

অপু তার মায়ের হাতে মাথা রাখল। কেরোসিনের লম্ফের টিমটিমে আলোয় তারা দুজনে মিলে পুরোনো দিনের গল্প করত। সেই রাতে সর্বাণী বুঝতে পারলেন, এই কষ্টের জীবনে তার একলা পথ চলা হয়তো কঠিন, কিন্তু তার পাশে অপুর মতো একলা একজন থাকলে সেই পথ হয়ে ওঠে ভালোবাসার আলোয় আলোকিত।

অপু আর সর্বাণীর সেই কুটির ছিল দারিদ্র্যের প্রতীক, কিন্তু তাদের হৃদয়ের বন্ধন ছিল অটুট। সর্বাণী জানতেন, এই সংগ্রাম তাঁর ছেলেকে একদিন বড় করে তুলবে, আর সেইদিনই তাঁর জীবন সার্থক হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *